দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধনের এক বছর পার হলেও লোহাগাড়া রেল স্টেশনে থামছে না কোনো ট্রেন। এতে স্থানীয়দের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কেন অবহেলার শিকার হচ্ছেন এখন সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে লোহাগাড়াবাসীর মনে। দ্রুত লোহাগাড়া রেল স্টেশনে ট্রেন থামানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ চেয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, এই রুটে পর্যটক এক্সপ্রেস, কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও ঈদ স্পেশাল নামে ৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন নিয়মিত চলাচল করে। এরমধ্যে পর্যটক ও কক্সবাজার এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ননস্টপ চলাচল করে। আর ঈদ স্পেশাল ট্রেনটি চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে ষোলশহর, জানালীহাট, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা ও রামু স্টেশনে থেমে কক্সবাজার রেল স্টেশনে গিয়ে যাত্রা শেষ করে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মানুষ প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত ভাড়া ও যানজটসহ নানা ভোগান্তি নিয়ে সড়ক পথে যাতায়াত করেন। কিন্তু রেল লাইন চালুর কিছুদিন পর থেকে ওই রুটে ঈদ স্পেশাল ট্রেন চালু হওয়ায় অনেক এলাকার মানুষ ট্রেন যাত্রার সুবিধা ভোগ করতে পারলেও বঞ্চিত লোহাগাড়ার মানুষ।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯২৯ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি চট্টগ্রাম–ষোলশহর লাইন, ১৯৩০ সালে ষোলশহর–নাজিরহাট লাইন, ১৯৩১ সালে দোহাজারী লাইন নির্মাণ কাজ শেষ করে। ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মায়ানমারের কাছে ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্প নেওয়ার সময় ২০১৩ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। তা বাড়িয়ে করা হয় ২০১৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭। ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন করেন। এরপর ১ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ঢাকা–কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১শ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করেছে। প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক থেকে উপজেলার আধুনগর খাঁন হাট বাজার ও চুনতি ইউনিয়নের হাজী রাস্তার মাথা এলাকা থেকে লোহাগাড়া রেল স্টেশনে আসা–যাওয়ার দুটি রাস্তা রয়েছে। উভয় দিকে অভ্যন্তরীণ সড়কের কাজ অর্ধেক করে থেমে আছে। মহাসড়ক থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রতিটি সড়কের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। বিকেলে সময় কাটাতে ও সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আশপাশের এলাকার অনেক লোকজনকে রেলস্টেশনে আসতে দেখা যায়। রেলস্টেশনের অবকাঠামোগত কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তারপরও কেন এই স্টেশনে কোনো ট্রেন থামছে না তা নিয়ে এলাকাবাসীর মনে নানা কল্পনা–জল্পনা। তবে লোহাগাড়াবাসী বার বার অবহেলার শিকার হচ্ছেন। এই নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা জানান, গত ১ ডিসেম্বর থেকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে বাণিজ্যিক ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছে। বিপুল যাত্রী চাহিদা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে চলছে মাত্র ২টি ট্রেন। এই রুটে চলা ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ও ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ বিরতিহীন হওয়ায় রেললাইনের সুফল পাচ্ছেন না দক্ষিণ চট্টগ্রামের যাত্রীরা। লোহাগাড়ার বুকের উপর দিয়ে প্রতিদিন ট্রেন যাতায়াত করলেও ঈদ স্পেশাল ট্রেন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন উপজেলাবাসী।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে ৮টি স্টেশনে ট্রেন থেমে যাত্রী উঠানামা করলেও লোহাগাড়া রেলস্টেশনে থামছে না ট্রেন।
চুনতির বাসিন্দা মোজাফফর আহমদ জানান, রেললাইন নিয়ে লোহাগাড়ার মানুষ খুবই উচ্ছ্বসিত ও আশান্বিত ছিল। কিন্তু প্রতিদিন বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন চলাচল করতে দেখি। শুধু চেয়ে থাকি। কোনোদিন ট্রেনে করে যাতায়াত করার সুযোগ হয়নি। কারণ লোহাগাড়া রেল স্টেশনে কোনো ট্রেন থামে না। লোহাগাড়া স্টেশনের আগে–পরে সাতকানিয়া ও চকরিয়া স্টেশনে ঈদ স্পেশাল ট্রেনটি থামতে পারলেও, কেন লোহাগাড়া উপজেলাবাসী এতো অবহেলার শিকার হচ্ছেন– এমন প্রশ্ন রাখেন চুনতির বাসিন্দা মোজাফফর আহমদ।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ লোহাগাড়া উপজেলার সভাপতি মোজাহিদ হোসাইন সাগর জানান, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি সরু হওয়ায় প্রতিনিয়ত যানজটসহ নানা ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। এছাড়া প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা লেগেই আছে। রেললাইন চালু হবার পর লোহাগাড়ার মানুষ রেলপথে যাতায়াত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন চালুর এক বছর অতিবাহিত হলেও লোহাগাড়া রেল স্টেশনে থামছে না কোনো ট্রেন। লোহাগাড়াবাসী রেলপথের সুফল থেকে বঞ্চিত। দ্রুত লোহাগাড়া স্টেশনে ট্রেন থামানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।
তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি কর্মকর্তা রাসেল জামান জানান, লোহাগাড়া রেল স্টেশনের স্ট্রাকচারাল কাজ ইতোমধ্যে শেষে হয়ে গেছে। শুধু কিছু ফিনিশিংয়ের কাজ বাকি আছে। তাও আগামী মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান জানান, ঈদ স্পেশাল ট্রেন মূলত ঈদের আগে–পরে কয়েকদিন চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে চলাচলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু যাত্রী চাহিদার কারণে সেটি আর বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ওই সময় কোনো কারণে হয়তো লোহাগাড়া রেলস্টেশনে ট্রেন থামানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। যেহেতু ঈদ স্পেশাল ট্রেনটি নিয়মিত চলাচল করছে, সেহেতু আগামী ২–৩ মাসের মধ্যে ওই ট্রেন লোহাগাড়া স্টেশনে থামানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে আরো নতুন ট্রেন যুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে। সেগুলোও অন্যান্য স্টেশনের মতো লোহাগাড়া রেলস্টেশনে থেমে যাত্রী উঠানামা করবে।