বিশ্বজুড়ে বর্তমানে শিক্ষার যে ধরনটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় উঠে আসছে , সেটি হলো স্টেম এডুকেশন। সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথেম্যাটিকস– এই চারটি বিষয়ের আদ্যক্ষর মিলিয়ে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে স্টেম এডুকেশন। এই সময়ে মানুষের জীবনে সব জায়গায় রয়েছে স্টেম শিক্ষার প্রভাব। যেমন– বিজ্ঞান ছাড়া এখন বিশ্ব অচল বলা যায়। জীবনের প্রতিটি জায়গায় রয়েছে বিজ্ঞানের প্রভাব। পাশাপাশি মানব সভ্যতায় প্রযুক্তি ক্রম বিকাশমান। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। প্রকৌশল এবং গণিতও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই চারটি বিষয়কে সমন্বিতভাবে শেখার নামই হচ্ছে স্টেম শিক্ষা।
সায়েন্স : বিজ্ঞান বা সায়েন্স মিশে আছে আমাদের প্রাকৃতিক জীবন– চাঁদ, সূর্য ও তারকারাজি, ভূমি ও সাগর, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রকৃতির বৈচিত্র্য, ছোট–বড় পশুপাখি ও অণুজীব, গাছপালা ও খাবার, আমাদের পৃথিবীর তাপমাত্রা, জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক পরিবহন ইত্যাদির সাথে। এই তালিকা অসীম।
টেকনোলজি: এখন টেকনোলজি বা প্রযুক্তি বলতে বোঝায় কমপিউটার বা স্মার্টফোন। কিন্তু প্রযুক্তি অস্তিত্বশীল টেলিভিশন, রেডিও, মাইক্রোস্কোপ, টেলিগ্রাফ, টেলিস্কোপ, কম্পাস, এমনকি সেই প্রথম দিকের চাকার মাঝেও।
ইঞ্জিনিয়ারিং: ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশল সূত্রে আমরা পাই ভবন, সড়ক ও সেতুর নকশা বা ডিজাইন। কিন্তু এই প্রকৌশলই চ্যালেঞ্জ নেয় আজকের দিনের পরিবহন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সমস্যা মোকাবেলা করে পরিবেশবান্ধব যন্ত্র, অ্যাপস্ ও সিস্টেম তৈরির। প্রকৌশল আমাদের জীবনের ও বসবাসের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে।
ম্যাথেমেটিকস: ম্যাথেমেটিকস বা গণিত কাজ করে আমাদের জীবনের সবখানে। মুদি দোকান, ব্যাংক, কর অফিস, পারিবারিক বাজেট থেকে শুরু করে জাতীয় বাজেট তৈরি ইত্যাদি কোথায় নেই গণিতের ব্যবহার। স্টেমের অন্যসব বিষয়গুলোও নির্ভরশীল এই গণিতের ওপর।
বিশ্লেষণমূলক অভিজ্ঞতায় এরইমধ্যে দেখা গেছে, স্টেম এডুকেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে জটিল সমস্যা সমাধানের মনোভাব ও দক্ষতা তৈরি হয়। বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের জানাশুনা তৈরি হয় এবং শিক্ষার্থীরা আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক হয়ে উঠতে পারে। এই শিক্ষার মূল বিষয়গুলো হচ্ছে: সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণ করা, টিম–ওয়ার্ক যোগাযোগ, ডিজিটাল জ্ঞান, সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি। স্টেম শিক্ষা নতুন জিনিস উদ্ভাবন করতে শেখায়। ফলে বাজারে নতুন–নতুন পণ্য ও সেবা আসে এবং এর ফলে ব্যবসা–বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। শেষ বিচারে দেশের অর্থনীতিতে সেটি অবদান রাখে।
স্টেম শিক্ষা মুখস্থ বিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করে। পাঠ্যবই না বুঝে মুখস্থ করার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে বিজ্ঞান এবং গণিতের মতো বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তাই পাঠ্য পুস্তকের বর্ণনাগুলো সহজবোধ্য হতে হবে। সেখানে দৈনন্দিন জীবন থেকে উদাহরণ তুলে ধরতে হবে।
স্টেম এডুকেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জটিল সমস্যা সমাধানের মনোভাব ও দক্ষতা তৈরি হয়। বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের জানাশোনা তৈরি হয় এবং শিক্ষার্থীরা আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক হয়ে উঠতে পারেন। স্টেম–শিক্ষা বলছে যে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিষয়গুলোর সমন্বয় করে গণিত এবং প্রযুক্তির সহায়তায় এমন এক সুসমন্বিত শিক্ষা–ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর সামনে তুলে ধরা হবে যাতে তার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, বাস্তবজ্ঞান, যেকোনও কিছুকে তার উপাংশে ভেঙে মূল সমস্যায় পৌঁছনোর ক্ষমতা আয়ত্ত হবে। এই দক্ষতার্জন একুশ শতকে ভীষণ জরুরি হয়ে গেছে। এখন জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষারও প্রয়োজন। তাই আধুনিক প্রকৌশলীয় কুশলতা এবং প্রাযুক্তিক দক্ষতার মাধ্যমে গাণিতিক বিশ্লেষণী টুল ব্যবহার করে বাস্তবধর্মী সমাধান করার ক্ষমতাকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ অনেক বিজ্ঞান–শিক্ষার্থীই নিউটনের গতিসূত্রগুলো জানলেও এর কোনও প্রয়োগ জানে না। বাস্তববর্জিত হাতেকলমে কাজবিহীন কুড়ি শতকের পাঠক্রমকে তাই ঢেলে সাজানো দরকার।
স্টেম কারিকুলাম বা পাঠক্রম হচ্ছে সমস্যাভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, যাতে শিক্ষার্থীরা সমাজে বিদ্যমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। এই কারিকুলামে ব্যবহার হয় সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পদক্ষেপ বা ইন্টারডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ। কারণ, এর লক্ষ্য– শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার দক্ষতা অর্জন ও উদ্ভাবনের সুযোগ করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনের বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান করতে শেখে। এই কারিকুলামের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের স্টেমের ক্ষেত্রগুলোতে শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা। এই ক্ষেত্রগুলো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে বিকশিত হচ্ছে।
উন্নত দেশগুলো মনে করছে, ভবিষ্যতে তাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে হলে স্টেম এডুকেশন অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। এরইমধ্যে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞগণ বলতে শুরু করেছেন, যেসব দেশ স্টেম এডুকেশনের উপর জোর দেবে তারাই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবে বলে। স্টেম এডুকেশনের একটি লক্ষ্য হচ্ছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং একুশ শতকের জন্য জনবল গড়ে তোলা। পশ্চিমা দেশগুলোতেই কেবল নয়, ভারত এবং চীনের মতো দেশও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্টেমকে গুরুত্ব দেওয়ার নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন বলেছে: ‘একুশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ, আমরা বৈশ্বায়ন ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি থেকে যেমনি উপকৃত হচ্ছি, তেমনি হচ্ছি চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি। এই নতুন তথ্যভিত্তিক ও উচ্চ প্রাযুক্তিক সমাজে সাফল্য পেতে শিক্ষার্থীদেরকে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে স্টেম বিষয়াবলীর ওপর। আর এই দক্ষতার মাত্রা হবে অতীতে আমরা যেমনটি ভেবেছি, সে তুলনায় অনেক অনেক বেশি।”
বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা স্টেম এডুকেশনকে উৎসাহিত করার মতো। নিয়মিত শিক্ষার পাশাপাশি দেশটিতে স্টেম বিষয়ক বিষয়াবলী শেখার বিভিন্ন আয়োজন করা হয়। এসব আয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান–ভিত্তিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও হয়ে থাকে। এসব আয়োজনে দেশের বিজ্ঞানীরা অংশ নেন এবং তারা বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন ল্যাবরেটরি এবং গবেষণাগার দেখানোর জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে তাদের অনুসন্ধিৎসু মন তৈরি হয়।
লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ সায়েন্স ফোরাম মনে করে, মানুষের মনে নানা ধরণের জিজ্ঞাসা, কৌতূহল এবং অনুসন্ধান শুরু হয় ছোটকাল থেকেই। এ সময় তারা পড়াশুনা এবং নানা ধরণের খেলাধুলার সাথে পরিচিত হয়। সুতরাং বয়স কম থাকতেই তাদের মনে এসব বিষয় নিয়ে আগ্রহ তৈরি করতে পারলে সেটি ভালো ফল দেয়। এক্ষেত্রে, স্কুলের শিক্ষকদের একটি বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করে। স্টেম শিক্ষা নিয়ে ছাত্র–ছাত্রীদের মনে কৌতূহল তৈরি করা এবং স্কুলে সে পরিবেশে পড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তবে কেউ কেউ মনে করেন, এর মাধ্যমে আর্টস এডুকেশনকে অনেক সময় অবহেলার চোখে দেখা হয়। স্টেম এডুকেশনের ওপর অতিমাত্রিক জোর দিয়ে সে এডুকেশনের পেছনেই শিক্ষা তহবিলের বেশিরভাগ খরচ করে মানবিক বিষয়গুলোর শিক্ষাকে অবহেলা করা হচ্ছে। এখন তাই বিশেষজ্ঞরা স্টেম–শিক্ষার সঙ্গে কীভাবে মানববিদ্যা এবং চারু ও কারুপাঠকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেটাও ভাবছেন। কেননা শুধু চুলচেরা বিশ্লেষণই নয়, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানবীয় আবেগ এবং সৃষ্টিশীল জিজ্ঞাসাও মানব মনের বৈশিষ্ট্য।
পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। ‘রিয়াল লাইফ সিচুয়েশন’ বা ‘বাস্তব পরিস্থিতিতে’ কীভাবে অবস্থা–বুঝে–ব্যবস্থা নিতে হয়–সেই কারিগরিও বৈজ্ঞানিক দক্ষতা আনা দরকার। পাহাড় সমান সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের দরকার হবে স্টেম–শিক্ষিত আধুনিক নাগরিক সমাজ। স্টেম এডুকেশনে পিছিয়ে পড়ার সরল অর্থ জাতীয় সমসা মোকাবেলায় আগের চেয়ে আরও পিছিয়ে পড়া। তাই ছোট–বড় ধনী–গরিব সব দেশের জন্য স্টেম এডুকেশন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বাবা–মাকেও তাদের শিশুদের স্টেম এডুকেশনের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে স্টেমবিষয়ক কর্মকাণ্ডও। এ সম্পর্কিত পাঠ্যবিষয়–বহির্ভূত কার্যক্রমেও তাদের আগ্রহ ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এসব কর্মকাণ্ড স্টেমসম্পর্কিত শিক্ষায় তাদের মেধাবিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে শিশু–কিশোরেরা বাস্তব জীবনে স্টেম এডুকেশনের প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারে। এভাবে স্টেম এডুকেশন আমাদের সমাজে এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্ব মানবসমাজের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ও দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল লিটারেসিতে বিশ্বাসী ম্যালকম টার্নবুল বলেছিলেন, ‘স্টেম নলেজের সূচনা করতে হবে স্কুলের একদম শুরুতেই। তাদের প্রযুক্তির নীরব ভোক্তা বানালে চলবে না। আমাদের শিক্ষকদের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের শেখানো– কী করে সৃষ্টি করতে হয়, কী করে কোড লিখতে হয়– ‘হাউ টু ক্রিয়েট, হাউ টু কোড’।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ),
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)