বিশ্ববাজারে হাজার কোটি ডলারের বিলেট রপ্তানির সম্ভাবনা কড়া নাড়ছে বাংলাদেশের দুয়ারে। চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাত প্রায় এক কোটি ডলারের বিলেট রপ্তানি করতে যাচ্ছে। আগামী নভেম্বরে তাদের ২৫ হাজার টন বিলেটবাহী জাহাজ নোঙর করবে চীনের বন্দরে। চীনে বিলেট রপ্তানি দেশের ইমেজ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এটা ধরে রাখা গেলে তৈরি পোশাক খাতের মতো স্টিল রপ্তানিও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় খাত হয়ে উঠবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উন্নয়নের সাথে স্টিলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। বিশ্বে মাথাপিছু স্টিলের গড় ব্যবহার ২০৮ কেজি। যুক্তরাষ্ট্রে ৬শ কেজি, চীনে ৫০৬, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪শ কেজি, জাপানে ১শ কেজি, ভারতে ৬৫ কেজি, শ্রীলংকায় ৫৫ কেজি, মিয়ানমারে ৪৮ কেজি, বাংলাদেশে ৪৫ কেজি, পাকিস্তানে ৪২ কেজি স্টিল ব্যবহার হয়। বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি ডলারের স্টিলের বাজার। যথাযথভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে এই বাজারের একটি অংশ যেকোনো উৎপাদক দেশের হাতের নাগালে আসার সুযোগ রয়েছে। তবে এজন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন।
জানা যায়, বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪শটি স্টিল মিল রয়েছে। এসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৮০ লাখ টন। স্টিলের বৃহৎ কারখানাগুলোর সবই চট্টগ্রামে। দেশের মোট স্টিল উৎপাদনের ৮০ শতাংশ উৎপাদিত হয় চট্টগ্রামে। বাকি ২০ শতাংশ রয়েছে ঢাকাসহ অন্য জেলায়। বৃহৎ কারখানার মধ্যে রয়েছে বিএসআরএম, একেএস, কেএসআরএম, জিপিএইচ ইস্পাত, আরএসআরএম ইত্যাদি। এসব কারখানার উৎপাদিত রডের প্রায় ৫৫ লাখ টনের অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে। স্টিল মিলগুলোতে নানা ধরনের স্টিল পণ্য যেমন রিবার (৮৫%), এঙ্গেল, চ্যানেল, ফ্ল্যাট বার, শিপ প্লেট, গার্ডার, বিম ইত্যাদি প্রস্তুত করা হয়।
স্টিল নিয়ে অগ্রগতি সন্তোষজনক মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিভিন্ন কারখানা সর্বাধুনিক নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্টিল পণ্য উৎপাদন করছে। মানসম্পন্ন স্টিল উৎপাদনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা অবকাঠামোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। দেশে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প গ্রহণ এবং মানসম্পন্ন স্টিল উৎপাদন পুরো সেক্টরকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বর্তমানে ইস্পাত সেক্টরে বার্ষিক টার্নওভার ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
স্টিল খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার স্টিল বিদেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্টিল সেক্টরকেও তৈরি পোশাক খাতের মতো রপ্তানি বাণিজ্যের একটি বড় খাত হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এই খাতে তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে অনেক বেশি স্থানীয় মূল্য সংযোজনের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায় যে স্টিল উৎপাদিত হয়, তাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজন গড়ে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি।
এই সুযোগ কাজে লাগানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। বার্ষিক দশ লাখ টন স্টিল উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন এই কারখানা চলতি অর্থবছরে অন্তত এক মিলিয়ন ডলারের স্টিল রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তারা প্রথম দফায় ১ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের ২৫ হাজার টন বিলেট রপ্তানি করতে যাচ্ছে। আগামী নভেম্বরে চীনে এসব বিলেট রপ্তানি করা হবে। চীনের জিয়াংগিন বন্দরে পণ্যগুলো পাঠানোর লক্ষ্য নিয়ে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে কোম্পানির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
২০০৮ সালে জিপিএইচ আড়াই হাজার টন বিলেট রপ্তানি করেছিল। তবে ওই সময় উৎপাদন প্রক্রিয়ার কিছু সমস্যার কারণে বিলেট রপ্তানির বাজার ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে জিপিএইচ বিশ্বমানের বিলেট উৎপাদন করে উল্লেখ করে কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল দৈনিক আজাদীকে জানান, জিপিএইচের আর্ক ফার্নেসটি বিশ্বে কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস নামে পরিচিত। এই প্রযুক্তি এতই আধুনিক যে, এখানে মানের সাথে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের আর কোনো বাধা নেই। এখন আমরা পৃথিবীর যেকোনো দেশে রপ্তানির উপযোগী বিলেটসহ নানা স্টিল উৎপাদন করতে পারছি। বিশ্ববাজারে আমরা এখন কারো থেকে পিছিয়ে নেই। প্রয়োজন শুধু বাজার ধরা এবং যথাযথভাবে পণ্য রপ্তানি করা।
তিনি বলেন, আমরা চীনের বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আগামী মাসেই ২৫ হাজার টন বিলেট রপ্তানি করছি, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮৭ কোটি টাকা। এই ধারা অব্যাহত রেখে চলতি অর্থবছরে অন্তত একশ মিলিয়ন ডলারের বিলেট রপ্তানি করতে চাই। তিনি আরো বলেন, দেশের স্টিল সেক্টর বিকশিত হয়েছে। এই সেক্টরকে কাজে লাগানো গেলে কোটি কোটি ডলারের স্টিল রপ্তানি করা সম্ভব।
অপর এক স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে বলেন, জিপিএইচ যা শুরু করেছে একটু চেষ্টা করলে অন্যরাও তা করতে পারবে। পৃথিবীব্যাপী স্টিলের বাজার রয়েছে। এই বাজার ধরার সুযোগও অবারিত। বিশ্বের বাজার ধরাটাই এখন আমাদের টার্গেট হওয়া উচিত। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই বাজার দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।