১. ব্রেকফাস্টের প্রয়োজনীয়তা
ব্রেকফাস্ট খুব প্রয়োজনীয় এ কারণে যে, দিবসের প্রথমভাগে ব্রেকফাস্ট শরীরে শক্তি যোগায়। শরীর তাতে মোটামুটিভাবে সারাদিনের রসদ পেয়ে যায়। শিশু ছোট হোক বা টিন–এজের, যদি ভালভাবে ব্রেকফাস্ট করে নেয়, তবে সে বেশি শক্তি পায়, স্কুলে ভালো করে, সারাদিন ভালভাবে খেয়ে–পড়ে কাটাতে পারে। অন্যথায় শিশু খুব খিটখিটে, অস্থির ও ক্লান্ত থাকে।
যে শিশু প্রায় ৪– ১২ ঘণ্টা, বা পুরো ঘুমকালীন সময়ে না খেয়ে থাকে, তাকে এখনি এনার্জি জোগানো উচিত। সামান্য কিছু না খেলে সকালের খানিক পরে তার মুড পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
ব্রেকফাস্ট ‘ব্রেইন পাওয়ার’ হিসেবে কাজ করে। বিশেষত: তা যদি দানাদার, আঁশযুক্ত খাবার হয়। তখন শিশু–শরীর পায় মনোযোগ, শক্তি ও স্মরণ ক্ষমতা।
ব্রেকফাস্টে ক্যালসিয়াম, আঁশ ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ থাকার কারণে শিশুর ওজন নিয়ন্ত্রিত থাকে, রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। এসব শিশুতে পেটে ব্যথা ঊপর্সগও স্কুল অনুপস্থিতির হার কম।
ব্রেকফাস্টের নীতিমালা–
একটু আগে (মিনিট দশেক হলেও চলে) সবাই বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়া ভালো।
তাজা ফলমূল, কলা, স্যান্ডউইচ, বিভিন্ন শাকসবজির খাদ্যসামগ্রী নিয়ে রান্নাঘর যেন ভরাট থাকে– আগের রাতে তা খেয়াল করে রাখা।
এতে করে টেবলে রাখা নানা মেন্যু থেকে শিশু নিজেরটা পছন্দ করে নিতে পারে। প্রয়োজনে ব্যাগে ভরে নিক, ক্লাস বিরতির মাঝখানে খেয়ে নিলেও চলবে।
তবে স্কুল থেকে কিছু কিনে নিয়ে খেলে স্বাস্থ্যকর কোন আইটেম খাবার জন্য সে কিনবে, তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
স্বাস্থ্যকর ব্রেকফাস্ট–
সুষম ব্রেকফাস্ট কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফাইবার দিয়ে সাজানো দরকার।
শর্করা বা কার্বহাইড্রেট: শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি যোগায়। যেমন দানাদার খাবার, চাল, রুটি, ফল শাকসবজি।
আমিষ বা প্রোটিন: কম ফ্যাটযুক্ত ডেইরি প্রোডাক্টস, মাংস, ডিম, বাদাম।
আঁশ বা ফাইবার: শাকসবজি, ফলমূল, পাউরুটি, শস্যদানা ইত্যাদি।
২. সুষম টিফিন
শিশুবিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিজ্ঞানী কিংবা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীর বলেন– একই সঙ্গে খাবার স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু করা যায়। প্রতিদিন সেই একই রকমের খাবার– বড়দেরও অরুচি ধরে যায়। শিশুর জিব্ বেশি স্বাদ, বেশি বৈচিত্র্য সন্ধান করে। পরিবারে যেসব খাদ্যতালিকার প্রচলন, শুধু এর ব্যবহার করেই খাবারে স্বাদ–বৈচিত্র্য ধরে রাখা যায়।
খাবার শুধু জিবের তৃপ্তি মেটানোর দায়িত্ব পালন করেই ক্ষান্ত থাকে না; দর্শন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও উদ্দীপ্ত করে। পদগুলোর আকার–আকৃতি, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ শিশুকে মাতায়। মাশরুমের কথা ধরা যাক–স্বাদ তেমন আহামরি নয়, কিন্তু দেখতে এত পেলব, জিবে জল আনে। সুতরাং মা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে এটুকু স্বীকার করে নিতে হয়– একটু মাথা খাটিয়ে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় একটু শাকসবজির আইটেম একেক দিন বদলিয়ে, একটু অন্যভাবে রান্না করা হলে টিফিন–বক্সে শিশু উঁকি দেবে।
যেমন– যে কোন এক সপ্তাহের মেন্যু:
শনিবার: বরাবরের সাদা রুটি না হয় বাদ যাক। এর পরিবর্তে আসুক বাদামি পাউরুটি। যদি তাও প্রতিনিয়ত পছন্দ না করে, তাহলে পিঠা তৈরির কথা কি ভাবা যায়!
রোববার : যদি ঘরে তৈরি স্যুপ তাকে আকৃষ্ট করে, তবে ভালো তরকারির বদলে আজ তা–ই দেওয়া যায়। তবে বাজারের মোড়কজাত স্যুপ নয়, যা প্রায়শ: অস্বাস্থ্যকর। পনিরের টোস্ট বানিয়ে দেওয়া যায়।
সোমবার: আজ দেওয়া যেতে পারে ফল দিয়ে তৈরি সালাদ। তরমুজ, পেঁপে, আপেলের টুকরো। সাথে আঙুর জোগানো হলে, ফ্রুট সালাদ তাকে দারুণ মাতাবে।
মঙ্গলবার: প্রতিদিন একই পানীয় জল, আজ না হয় তার পানীয় বোতলে লেবুজলের শরবত দেওয়া হোক। তার পছন্দের সবজি দিয়ে পদ তৈরি করা যায়, অথবা ঘিয়ে ভাজা পারোটা।
বুধবার: মাখন স্যান্ডউইচ, শস্যকণা সমৃদ্ধ সস্।
বৃহস্পতিবার: চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করা নতুন কিছু। ময়দা, আটা, পেস্তাবাদাম যা ইচ্ছা উপাদান মিলিয়ে।
বাংলাদেশে বিদ্যালয়গামী শিশুরা আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা, দাঁতের ক্ষয়রোগ, গলগন্ড, প্রোটিন–ক্যালরির ঘাটতিজনিত অপুষ্টি, ‘এ’ ভিটামিনের অভাবজনিত দৃষ্টিশক্তির সমস্যা প্রভৃতিতে জর্জরিত। স্বাস্থ্যকর টিফিন (হোক তা বাসায় তৈরি কিংবা ‘লাভ– লোকসান নেই’ রীতিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে বরাদ্দ করা) যদি এসব পুষ্টিমাণ নিশ্চিত করে, তবে শিশু স্বাস্থ্যবান থাকবে। বলা হয়, শিশুর দৈনিক চাহিদার এক–তৃতীয়াংশ ক্যালরি ও অর্ধেক পরিমাণ প্রোটিন টিফিনের মাধ্যমে শিশুকে জোগানো প্রয়োজন।
৩. লাঞ্চ
স্কুল ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ যেন শাকসবজী ফলমুল ও দানাদার খাদ্যযুক্ত হয়, ও তাতে কম চর্বি থাকে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক, শিক্ষক ও ফুড ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্ব পালন করা উচিত। প্রয়োজনে সপ্তাহ শেষে ফুড মেন্যু পরিবর্তন করা নিয়ে মা–বাবার মধ্যে আলোচনা দরকার।
শিশুর স্কুল গ্রেডের ওপর ভিওি করে তার খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া।
ক্যালরি, চর্বি জাতীয় খাবার ও লবণের পরিমাণ যেন ন্যূনতম ও মাত্রাতিরিক্ত– এ দুইয়ের মাঝখানে থাকে।
ভেজিটেবল অয়েল দিয়ে রান্না করা খাবার থাকা ভালো। তবে ক্যালরির (এনার্জি) পরিমাণ যেন বেশি না হয়, তা খেয়াল করতে হবে।
ভেজিটেবলও থাকবে, ফলমুলও থাকবে, একটা দেয়া হলে অন্যটার প্রয়োজন নেই – এমন ভাবা ঠিক হবে না।
লাঞ্চ খাবারে অবশ্যই যেন শাকসবজী প্রয়োজন মাফিক থাকে: ১/২ কাপ ঘন সবুজ সবজী, ১/২ কাপ হলুদ সবজী।
ফলের রস দেয়া যাবে, তবে তা যেন সরবরাহকৃত ফলের পরিমাণের অর্ধেকের বেশি না হয়।
পরিবেশন কৃত পাউরুটি ও দানাদার খাবার যেন সমপরিমাণ থাকে।
দুধ যেন চর্বিযুক্ত না হয়।
শিক্ষার্থীরা যেন তাদের পছন্দমাফিক ফলমুল নিতে পারে, সেই সুবিধা বজায় রাখা।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।