বছরের প্রথম দিন। ১লা জানুয়ারি ২০২৪। সেদিন ছিল বই উৎসব। দেশের প্রতিটি স্কুলে এই বই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত লাখ লাখ শিক্ষার্থী। তারা নতুন ছাপানো বই হাতে পেয়ে বেজায় খুশি। বই হাতে পাওয়ার পর পাতার পর পাতা উল্টিয়ে নতুন নতুন ছবি দেখতে, বইয়ের ঘ্রাণ নিতে তাদের দেখা গেছে। উৎসবের আনন্দে সামিল হলাম আমিও। সেদিন ভোরে সেই আনন্দময় দিনে শিশু–কিশোরদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে চলে যাই বায়েজিদ মডেল স্কুলে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যক্ষ মো. মাজহারুল হকের আমন্ত্রণে আমি যথাসময়ে পৌঁছে যাই তাদের মাঝে। আমার সঙ্গে ছিলেন সমাজ ব্যক্তিত্ব পরিমল ধর ও বাচিকশিল্পী আয়েশা হক শিমু। আমি প্রত্যক্ষ করলাম এক অভাবনীয় আয়োজন। বই উৎসব পরিণত হয়েছে আনন্দ উৎসবে। বই নিয়ে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন অসাধারণ এক কবিতা:
বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে
বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।
যে–বই জুড়ে সূর্য ওঠে
পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে
সে–বই তুমি পড়বে।
যে–বই জ্বালে ভিন্ন আলো
তোমাকে শেখায় বাসতে ভালো
সে–বই তুমি পড়বে।
বছরের প্রথম দিন নতুন বই হাতে পেয়ে শুধু শিক্ষার্থীই নয়, তাদের অভিভাবকেরাও আনন্দিত হয়েছেন। নতুন বই শিশুকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ শিশুকে পড়ালেখার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা শিশুর মনোজগতে বিস্ময় তৈরি করে। শিশুমনের এ আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণের সূচনা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন বই উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই বলা যায়, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বিনামূল্যে বই বিতরণের ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আশাব্যঞ্জকভাবে কমে এসেছে। যা আমাদের দেশের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও দেশের অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বায়েজিদ মডেল স্কুলে গিয়ে দেখলাম শিক্ষকরা প্রায় সকলেই ছুটছেন শিক্ষার্থীর পেছনে। তাঁরা শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করে তুলতে সর্বদা তৎপর। তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় কীভাবে করা যায়। তাঁরা শিশুকে নেহায়েত শিশু মনে করছেন না। তাঁরা বোঝেন, শিশু হয়তো বয়সে ছোটো, আকারে ছোটো। কিন্তু তার আবেগ, রাগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, বোঝার ক্ষমতা, ঈর্ষা–সবকিছুই বয়স্ক মানুষের মতো। যদি তাকে অবহেলা করি, তাকে বঞ্চিত করি, সে কিন্তু নিমিষেই টের পাবে। এই বিষয়টা সূক্ষ্মভাবে মাথায় নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা।
আসলে শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গেলে আমাদের শিশু হতে হবে। শিশুদের মনস্তত্ব বুঝতে হবে। শিশুর চাহিদা, তার মানসিকতা, তার চিন্তা চেতনাকে বুঝতে হবে। একজন শিশুর কাছে প্রথম আদর্শ তার শিক্ষক। শিক্ষক তার কাছে নায়কের মতো। এজন্য শিশুর চিন্তা চেতনার মধ্যে এমনভাবে একজন শিক্ষককে ঢুকতে হয়, যাতে শিশু আগামী দিনের স্বপ্ন দেখতে পায় সহজ ও সাবলীলভাবে। যাতে তার আবেগ অনুভূতি দিয়ে জীবনকে দেখতে পায়। বুঝতে পারে পরিবেশকে।
শিক্ষক তাঁর শ্রেণিকক্ষে শিশুদের কাছে সফল মানুষের গল্প শোনাতে পারেন। আদর্শবান মানুষের উপমা তুলে ধরতে পারেন। একজন শিশু কীভাবে স্বপ্ন দেখবে, কীভাবে জীবনকে রঙিন করবে, সবকিছুই প্রদর্শন করে ইঙ্গিতময় স্বপ্ন তৈরিতে সহায়তা করবেন তাঁরা। শিক্ষার্থীর ভিতরের সুপ্ত প্রতিভাগুলোর সন্ধান দিতে পারেন একজন আদর্শ শিক্ষক।
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান শিশুদের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে ‘আনন্দযোগ নেই’ মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শোচনীয়। এখানে শিশুদের পরীক্ষার নামে রীতিমতো পীড়ন করা হচ্ছে। এতে বিন্দুমাত্র আনন্দযোগ নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা এখন পরীক্ষাসর্বস্ব, জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আমরা নষ্ট করে ফেলেছি।’ ‘সহজপাঠ: শিশুর সামগ্রিক বিকাশ’ শীর্ষক এক আলোচনায় তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। সেজন্য বর্তমান সরকার প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যুক্ত করে এই স্তরে পরীক্ষা বাতিলের পরিকল্পনা করেছেন।
ভালো লাগার বিষয় এই যে, বায়েজিদ মডেল স্কুলের মতো স্কুলে কর্তৃপক্ষ ছড়াকবিতা, গল্প, চারুকলা, আবৃত্তি ও সংগীতকে তাদের পাঠকার্যক্রমের সঙ্গে যোগ করে নিয়েছেন। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে তাঁরা শুনছেন ছাত্র–ছাত্রীদের নিজেদের কথা। তাঁরা জানেন, শিশুকে তার চিন্তার স্বাধীনতা দিতে হবে। তার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে সে কী বলতে চায়, তা শুনতে হবে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়ে শিশুরা নিজেরা কী ভাবছে, তা আমাদের শুনতে হবে। শিশুরা স্কুলে এসে যেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে, তারজন্য তাকে তৈরি করে তুলতে হবে।
অস্বীকার করা যাবে না, সাফল্যের দৌড়ে লিপ্ত হয়ে পড়ায় ছেলেমেয়েরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে গেছে। তাই ইদানীং দেশে সাফল্য চর্চার ও সাফল্যের আপন ঢোলটি বাজানোর প্রতিযোগিতা চলছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান লিখেছিলেন, ‘বইয়ের চাপ, সিলেবাসের চাপ, পরীক্ষার চাপ, সৃজনশীল শিক্ষার চাপ–প্রভৃতি চাপে পড়ে শিশুরা পিষ্ট। কিন্তু কোথাও সন্তুষ্টি নেই কারও। কেউ ফেল করে কাঁদছে, কেউ কাঙ্ক্ষিত জিপিএ না পেয়ে কাঁদছে। কারও যদি জিপিএ ভালো তো জিপিএ গোল্ডেন নয়, তাই কাঁদছে। তার সঙ্গে উটকো যোগ হয়েছে নম্বরের চাপ। গোল্ডেন পেলেও কম নম্বরে জিপিএ পেয়েছে, তাই কাঁদছে। একটু ভুল হলো, তাদের কাঁদাচ্ছে মা–বাবা, কাঁদাচ্ছে শিক্ষক, স্কুল এবং স্বয়ং রাষ্ট্র। কাউকে পেটাচ্ছে বেদম। কাউকে বা বকছে। ভুলে যাচ্ছে, শিশুরও আত্মসম্মান আছে। কোমল সম্মানে আঘাত এলে তা অসহ্য হয়ে ওঠে। সর্বক্ষণ নিপীড়নের শিকার হয়ে যাচ্ছে মানসিক প্রতিবন্ধী। সে হাসতে ভুলে যাচ্ছে, খেলতে ভুলে যাচ্ছে, খেতে তার অরুচি হচ্ছে, কথা বলতে চাচ্ছে না। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাবা–মা, শিক্ষক, স্কুল আর রাষ্ট্রের সম্মিলিত চাপে নিষ্পেষিত শিশুর মেজাজ যাচ্ছে রুক্ষ হয়ে। বুদ্ধিজড় শিশু বেছে নিচ্ছে মাদক, না হলে সাইবার সাইটে ডুবে যাচ্ছে। এভাবে আমরা তৈরি করছি এক নিষ্ঠুর প্রজন্ম।’
সরকার প্রতিবছর বিনা মূল্যে বই দিচ্ছে। এটি একটি চমকপ্রদ অর্জন নিঃসন্দেহে। সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ তথা শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে হলে তাদের পড়াশোনা শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমিত করে রাখলে চলবে না। তাদের অন্য ভালো বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। যে বই আমাদের মানস গঠনে সহায়ক। বই আমাদের প্রিয় সঙ্গী। ছোটোদের জন্য আমি লিখেছিলাম :
বাঁচার জন্য আমাদের চাই আলো
তার সাথে চাই সুশীতল বায়ু ভালো।
তার সাথে চাই বিশুদ্ধ সব জলও
প্রয়োজন জানি নানা রকমের ফলও।
বাঁচার জন্য আমাদের চাই কী কী
সোনা রোদ্দুর–জোছনার ঝিকিমিকি
বৃষ্টির জল নদী কলকল আর
সবুজ শস্য স্বর্ণ পাতাবাহার!
বাঁচার জন্য আমাদের চাই আলো
বাঁচার জন্য ঘোচাতেই হয় কালো
কালোকে ঘোচাবো কী করে কী করে জানো?
আলোর পর্শে সবুজাভ হবে প্রাণও।
আলো দিতে পারে বুকের মধ্যে কারা?
জ্ঞান নিয়ে আজ চারদিকে মাতোয়ারা?
বিদ্যাসাগরে কারা করে থই থই?
বুকের মধ্যে যাদের রয়েছে বই।
বই পারে সব বদলাতে মনোভঙ্গি
সকলের কাছে বই তাই প্রিয় সঙ্গী।
শিশুদের এভাবে বইয়ের সঙ্গে রাখতে হবে। শ্রেণিকক্ষকে রাখতে হবে আনন্দময়।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর –৪২২), বাংলা একাডেমি।