ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর ‘অসুখ’ ছবিটি নির্মাণের সময় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সৌমিত্রদাকে নিয়ে এক বড় মুশকিলে পড়েছি। কিছুতেই তাঁকে বুড়ো বানানো যাচ্ছে না। ঋজু টান টান শরীর। শরীরে কোথাও শৈথিল্য কিংবা বলিরেখা নেই। শেষপর্যন্ত অনেক চেষ্টা চরিত্র আর মেকআপ করিয়ে তাঁকে ‘অসুখ’ ছবির বয়োবৃদ্ধ বাবার অবয়বে এনেছিলেন ঋতুপর্ণ। তখনই সৌমিত্রের পরিণত বয়স। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন, পরিশীলিত শিল্পচর্চা আর আধুনিক মননশীলতার কারণে জীবনের শেষসময় পর্যন্ত তাঁর সেই ঋজুতা অক্ষুন্ন ছিল। তারপরেও নির্মম কোভিডের আক্রমণে ৪০ দিনের জীবনযুদ্ধের শেষে হার মানতে হলো এই শিল্প মহীরুহকে ১৫ নভেম্বরের দুপুরে। সালটা সেই ২০২০। দুঃসহ এই বছরটাতে এই কোভিডের কালগ্রাসে কতজনকে যে হারাতে হলো, ভাবলেই ব্যথায় মন ভরে ওঠে। সৌমিত্র ক্যান্সারেও ভুগছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে ১৯৫৯ সালে। সেই থেকে শাখা প্রশাখা (১৯৯০) পর্যন্ত সত্যজিতের ১৪টি কাহিনীচিত্র ও দুটি প্রামাণ্যচিত্রে (রবীন্দ্রনাথ ও সুকুমার রায়) অভিনয় করেছেন তিনি। নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে যুগ্মভাবে ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। যেটির সঙ্গে নানাভাবে সত্যজিৎ রায়ও যুক্ত ছিলেন। সত্যজিৎ মানসে প্রভাবিত সৌমিত্রকে তাই সত্যজিতের মানসপুত্রও বলা হয়ে থাকে।
ফেলুদা নিয়ে যে দুটি ছবি সত্যজিৎ করেছেন দুটিতেই ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। ফেলুদা সিরিজের সব ক’টি বইয়ের ইলাসট্রেশনে ফেলুদার যে অবয়ব আমরা দেখি তার সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। ফলে পরবর্তী সময়ে ফেলুদাকে নিয়ে তৈরি ছবিগুলোতে ফেলুদা চরিত্রে বিভিন্ন অভিনেতাদের মেনে নিতে কেমন যেন মন সায় দেয় না। তেমনি সত্যজিতের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে যখন তিনি অভিনয় করেছেন, প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে এমনভাবে তিনি একাত্ম হয়ে গেছেন, ঐ চরিত্রের বাইরে যেমন তাঁকে অন্যকিছু ভাবা যায়নি, তেমনি মনে হয়েছে চরিত্রটি যেন তাঁরই জন্যে সৃষ্ট।
সত্যজিতের ছবির বাইরে মৃণাল সেন, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, অজয় কর, হরিসাধন দাশগুপ্ত নিত্যানন্দ দত্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে হালের কৌশিক, সৃজিত, নন্দিতা-শিবপ্রসাদ, লীনা-শৈবাল সকল প্রতিভাবান পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। রুচিশীল-বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি হার্ডকোর বাণিজ্যিক ছবিতেও অভিনয় করেছেন। পেশাদারিত্বের প্রয়োজনে করতে হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, সেখানেও তিনি সম্পূর্ণ সফল। তিন ‘ভুবনের পারে’ ছবিতে সৌমিত্রের সেই অসাধারণ নৃত্য সত্যিই অবিস্মরণীয়। তেমনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে পাষণ্ড পণ্ডিত সংসার সীমান্তে, অগ্রদানী, কোনি, এক জীবন প্রভৃতি মূল ধারার ছবিতে তাঁর অসামান্য অভিনয়। চলচ্চিত্রের অভিনয়কে তিনি অন্য এক মাত্রায়, ভিন্ন উচ্চতায় তুলে দিয়েছিলেন। এই কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে বিভিন্ন সময় উল্লেখ করেছেন নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরীর মতো প্রথিতযশা অভিনেতারা। একই সময়ে তিনি রোমান্টিক নায়ক ও দুর্ধর্ষ ভিলেনের চরিত্রে (ঝিন্দের বন্দী, সুদূর নীহারিকা) অবলীলায় অভিনয় করেছেন সমান দক্ষতায়। ছিলেন স্তানিশ্লাভস্কি রীতির একজন সার্থক অভিনেতা। ঋত্বিক ঘটকের সাথে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাজ করা হয়ে ওঠেনি। বছর কয়েক আগে ঋত্বিককে নিয়ে একটি বিপরীতধর্মী মন্তব্য তাঁর জবানে দুয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলে, বিতর্কের ঝড় ওঠে। কিন্তু সৌমিত্র এটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তাঁর পরিশীলিত চরিত্রের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষেই এই আচরণ সামঞ্জস্যহীন। এটা ছিল তাঁকে হেয় করার জন্য নিতান্তই অপপ্রচার।
সৌমিত্র চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মঞ্চ, টেলিভিশন ও যাত্রায় অভিনয় করেছেন। নাটক রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন। ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন অনেক। চিত্রশিল্পেও সুষম চর্চা ছিল তাঁর। বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে ছড়া, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ও অনুবাদের। আত্মস্মৃতি ও চলচ্চিত্র বিষয়ক বেশ কিছু উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ রচনা করেছেন। আবৃত্তি শিল্পেও প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বকীয় ঔজ্জ্বল্য। তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু বেতার ঘোষক হিসেবে আকাশবাণী কোলকাতায়। মঞ্চকেও প্রাধান্য দিতেন। ছিলেন শিশির ভাদুড়ীর শিষ্য। চলচ্চিত্রে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়কে। দুই মায়েস্ত্রোম সাহচর্য ও শিক্ষায় নিজেও পরিণত হয়েছিলেন মায়েস্ত্রোতে। হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী। রেয়ার ভার্সেটাইল জিনিয়াস। ৬০ বছরের বেশি সময় শিল্পের বিভিন্ন শাখায় নিরবচ্ছিন্ন এক পথচলা। স্বভাবতই প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্যের সোনার হরিণ ধরা দিয়েছে তাঁর হাতে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সৌমিত্রের ইংরেজিতেও তুখোড় দক্ষতা ছিল। এত কিছুর পরেও তাঁর মুখ্য পরিচয় সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের প্রধান অভিনেতা। চলচ্চিত্র পরিচালনায় উদ্যোগী না হলেও দূরদর্শনের জন্যে রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেছিলেন টিভি সিরিয়াল ‘স্ত্রী কা পত্র’।
প্রায় সব অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করলেও বৈদগ্ধ্যের দিক থেকে শর্মিলা, অপর্ণা এবং মাধবীর সঙ্গেই ছিল তাঁর যথাযথ রসায়ন। স্বভাবতই প্রচুর সম্মাননা পেয়েছেন। তবে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন একটু দেরিতে। এ নিয়ে একটু অভিমানও ছিল। ২০০৮ সালে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘পদক্ষেপ’ ছবির জন্যে অথচ এর আগে পেয়েছেন ‘পদ্মবিভূষণ’ ২০০৪ সালে। ২০১২ সালে পান রাষ্ট্রীয় আজীবন সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পদক। ২০১৮ সালে ফরাসি সরকার তাঁকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘লিজিয়ঁ দ্য’ নর’-এ ভূষিত করেন। ফরাসি চিত্রপরিচালক ক্যাথরিন বার্জ তাঁকে নিয়ে ‘ট্রি’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
এই মহাশিল্পীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালে কলকাতায় ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। আমার জীবনের পরম স্মৃতিসম্পদ হয়ে রয়েছে স্মরণীয় সেই মুহূর্তগুলি। তাঁর জন্ম ১৯৩৫-এর ১৯ জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। আদিবাড়ি কুষ্টিয়ায়। ৮৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন পরিক্রমার পরিসমাপ্তি ঘটলো ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর। ঘটলো বিশ্ব চলচ্চিত্র ও বাংলা সংস্কৃতির এক বর্ণময় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি।