প্রায় হাজার বছর ধরে সৌদি আরবের মানুষ ব্যবসা ও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধে সৌদি আরব পাকিস্তানকে সমর্থন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন দেশ স্বীকৃতি প্রদান করলেও সৌদি আরব তখনো স্বীকৃতি প্রদান করেনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৫–৭৬ সালে সৌদি আরব এবং বাংলাদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবের সাথে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তখন থেকে বেশ কিছু দক্ষ এবং অদক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক সৌদি আরবে কাজ করতে পাঠানো হয়। বর্তমানে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশি প্রায় ২৬ লক্ষ। সৌদি আরবে প্রতি বছর প্রায় ১ লক্ষ মানুষ হজ করতে যায় এবং ওমরা যাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। পড়াশোনার জন্য বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি গমন করে। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করে এমন দেশের মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম প্রধান দেশ।
সৌদি আরবে প্রবাসীদের প্রায় সিংহভাগই সাধারণ শ্রমিক। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পেশাজীবীও আছেন। নারীরাও আছেন গৃহকর্মীসহ আরও নানা পেশায়। সাধারণ প্রবাসী শ্রমিকদের বিরাট অংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তাই বাংলাদেশের পরিচিতি মূলত পরিচ্ছন্নতাকর্মী রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে। আফসোসের বিষয় হলো দক্ষ কর্মী রপ্তানির তেমন কোনো অবকাঠামো দেশে গড়ে উঠেনি। তাই আমার দেশের সন্তানেরা মরুর দেশে কঠোর কায়িক শ্রম অথচ কম বেতনে কাজ করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে চলেছে। অবশ্য তাদের দুর্ভোগের শুরু হয় দেশের মাটিতে। নানা সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে পড়ে, ধার দেনা করে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুন বেশি দাম দিয়ে ভিসা কিনে তারা এখানে এসে দেখে, প্রতিশ্রুতির সাথে বাস্তবতার অনেক ফারাক।
মক্কা ও মদিনার অবস্থানের কারণে সৌদি আরবের একটি আলাদা স্থান আছে ধর্মপ্রাণ প্রবাসী কর্মীদের কাছে। তারা সুযোগ পেলেই এই দুই জায়গায় ছুটে যান ওমরাহ এবং নবী করিম সা. এর রওজা জিয়ারতে।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের জীবনে ঈদও বেদনাবিধুর। এই বেদনা উৎসারিত হয় প্রিয়জনের বিরহে। প্রিয়জনের সান্নিধ্য থেকে হাজারো মাইল দূরে ঈদ এখানে খুশির বার্তা নিয়ে আসে না। এরপরে দেশে পরিবার–পরিজনের সাথে কথা বলে, আশেপাশের বন্ধু–বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে কিংবা টিভি দেখে ঈদের দিনটি কাটিয়ে দেয়।
এই দেশের বিভিন্ন শহরে বাঙালি এলাকা আছে। এই জায়গাগুলোতে বাংলাদেশিরা সেলুন, রেস্তোঁরা, কাপড়ের দোকান, মুদির দোকান, ফার্মেসি, সবজি বা মাংসের দোকান ইত্যাদি নানাবিধ ব্যবসা করে। মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি।
দোকানপাটে বাংলা নাম কিংবা যত্রতত্র পানের পিক দেখে নতুন যে কারো মনে হতে পারে বাংলাদেশে চলে এলাম বুঝি। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে ‘সুক বাংগালি’ বা বাংলা বাজার বলে। এই ‘সুক বাংগালি’ বাংলাদেশিদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলিতে এই বাজারগুলো শ্রমিক ভাইদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠে। শুঁটকি থেকে শুরু করে লুঙ্গি, দেশীয় প্রায় সব জিনিসই এখানে পাওয়া যায়।
এখানে সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিসটা পাওয়া যায় সেটি হলো ভীষণ একাকিত্বের প্রবাস জীবনে দূরদূরান্ত থেকে আসা প্রিয়জন অথবা বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্য। এ যেন মরুভূমির তপ্ত বালুকাবেলায় এক টুকরো মরুদ্যান। কেউবা দাঁড়িয়ে সুখদুঃখের গল্প জুড়ে দেন। কেউবা বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোতে দেশ বিদেশের অবস্থা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলেন। বেলাশেষে যখন ঘরে ফেরেন, তখন শুধু বাংলাদেশি দোকানগুলো থেকে সদাই কিনেই নিয়ে যান না, সাথে নিয়ে যান আগামীর নিস্তরঙ্গ জীবনে সঙ্গ দেয়ার জন্য কিছু সুখস্মৃতি।
প্রবাসী কর্মীদের সিংহভাগেরই খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থাকে না। এখানে কর্মক্ষেত্রে ভালো করতে হলে আরবিসহ বিভিন্ন ভাষা জানতেই হয়। যখন কেউ এদেশে আসেন তাদের বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষা জ্ঞান থাকে শূন্যের কোটায়। আবার এখানে আরবি ও অন্য ভাষা শেখার প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাও নেই। তবুও টিকে থাকার অদম্য স্পৃহাই দ্রুত বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করে। তাই জীবন চলার পথে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরবিসহ ও অন্য কথ্য ভাষা শিখে নেয়। সৌদি সরকার নিয়ন্ত্রিত ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র আছে বিভিন্ন শহরে যেখানে উচ্চশিক্ষিত আলেমরা বিভিন্ন ভাষায় ধর্মীয় সবক দেন। প্রবাসীদের কেউ কেউ এখানে নিয়মিত হাজির হয়ে ধর্ম শিক্ষা লাভ করেন। প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে যারা পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সন্তানদের পড়াশোনা।
রিয়াদ, জেদ্দার মতো বড় কয়েকটি শহরে বাংলা স্কুল থাকলেও ছোট শহরগুলোতে প্রবাসীদের সন্তানেরা মূলত ভারতীয় বা পাকিস্তানি পাঠ্যক্রমের স্কুলেই পড়াশুনা করেন। প্রবাসী কর্মীদের হার না মানার ইস্পাত কঠিন মানসিকতা তাদের সন্তানদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। ফলে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিক্ষা জীবনে ভালো ফলাফলের মাধ্যমে সাফল্যের শিখরে উঠে যায়। আজকাল সৌদি সরকার স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বৃত্তির মাধ্যমে বিদেশিদের এইদেশে নানা বিষয়ে পড়াশুনার সুযোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসে।
পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে কৃষিবিপ্লবের নেতৃত্বে আছে বাংলাদেশি কর্মীরা। সৌদি আরবে বাংলাদেশি কৃষিকর্মীরা তাদের অভিজ্ঞতা আর সবুজের প্রতি নিদারুণ ভালোবাসাকে পুঁজি করে আবাদ করেন নানা জাতের দেশি বিদেশি শাক সবজি, ফলমূল ও মাছ। তারা যেখানে হাত দেন সেখানেই যেন সোনা ফলে। কঠোর পরিশ্রমী হাতের ছোঁয়ায় মরুভূমির মাঝে দেখা দেয় সবুজের হাতছানি, তপ্ত বালুকা বেলার মরুভূমি হয়ে ওঠে সুজলা–সুফলা ফসলের মাঠ। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল পৌঁছে যায় এই দেশের বিভিন্ন সুপারস্টোরে। তাদের কারণেই এই মরুদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরা সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে পাতে কয়েকটুকরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে।
দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও সময়ের সঙ্গে বাড়ছে প্রবাসীদের সমস্যা। দালাল ও অসাধু চক্রের খপ্পরে প্রবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে সৌদি শ্রমবাজারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস। এই ধারা সময়ের সঙ্গে বাড়ছে। দেশটিতে প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। যার প্রধান কারণ ‘ওয়ার্ক পারমিট ও আকামা’ সমস্যা। দালালরা কাজের কথা বলে দেশটিতে নিলেও কাজ দিতে ব্যর্থ হয় বা ভুক্তভোগী প্রবাসীকে কাজ খোঁজার জন্য বলে থাকে। এ ছাড়াও এক বছরের আকামার কথা মুখে বললেও দিয়ে থাকেন তিন মাস। ফলে নির্দিষ্ট সময় পর প্রবাসীরা অবৈধ হয়ে যান। অনেকে বাড়ি থেকে আকামা করতে পারলেও অধিকাংশ প্রবাসী অর্থের অভাবে আকামা করতে ব্যর্থ হন। পরে সৌদি আরবের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে কাজ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু একসময় তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কার্যকরী ভূমিকা রাখছেন প্রবাসীরা। এই প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় এবং এই অবস্থা থেকে উত্তোরণে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। প্রবাসীদের স্বার্থ সুরক্ষায় আরো বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। সৌদি আরবে বাংলাদেশের দূতাবাসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষাকারী আন্তরিক জনশক্তি নিয়োগ করা।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সৌদি আরবের নতুন বিনিয়োগ আইন অনুসারে, পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্যের জন্য বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য, সৌদি আরব একাধিক শিল্পের জন্য তার বাজার উন্মুক্ত করেছে। বিদেশীদের তাদের ব্যবসার ১০০% মালিকানা ভোগ করার অনুমতি দেয়। তবে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি এই বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছে না।
এভাবেই ভালো মন্দে কেটে যাচ্ছে প্রবাসীদের আটপৌরে জীবন। যেহেতু সৌদি আরবে নাগরিকত্ব পাওয়া যায় না তাই সব প্রবাসীর প্রত্যাশা থাকে কাজ শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার। অনেকে এখানে যৌবনের শুরুতে এসে বার্ধক্যে উপনীত হন। তাদের অধিকাংশই নিজের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে পারলেও, নিশ্চিত করতে পারেন না নিজেদের জন্য মানসিক দুশ্চিন্তামুক্ত এক পশলা শান্তির ঘুমের। জীবন এখানে এমন !
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।










