পক্ষে বিপক্ষে তুমুল বিরোধিতার পর অবশেষে লাইটারেজ জাহাজ চলাচলে সিরিয়াল প্রথা শুরু হচ্ছে। আগামী সোমবার বেলা ১১ টা থেকে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসি’র মাধ্যমে সিরিয়াল প্রথায় লাইটারেজ জাহাজ চলাচল করবে। গতকাল জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের মধ্যে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাহাজ চলাচল কার্যক্রম পরিচালিত হবে। গতকাল সকালে নগরীর একটি হোটেলে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জাহাজ ভাড়ার ব্যাপারটি আগামীকাল রোববারের মধ্যে নির্ধারণ করা হবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে বছরে অন্তত দশ কোটি টন পণ্য লাইটারেজ জাহাজে খালাস করে নানা গন্তব্যে পরিবহন করা হয়। এ কাজে যুক্ত বেসরকারি মালিকানাধীন প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ। দীর্ঘদিন ধরে এসব জাহাজ চলাচল এবং পণ্য পরিবহনের ব্যাপারটি ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) নিয়ন্ত্রণ করছিল। লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়েই ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়। ডব্লিউটিসির প্রবর্তিত সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ করে আমদানিকারকেরা জাহাজ ভাড়া নিয়ে পণ্য পরিবহন করতেন। জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে লোকাল এজেন্ট এবং আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যের এজেন্টে ডব্লিউটিসিতে দায়িত্ব পালন করতো। কোনো কোনো লোকাল এজেন্ট আবার পণ্যের এজেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। এই প্রক্রিয়ায় গত বেশ কয়েক বছর ধরে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনের জন্য পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসির কাছে প্রয়োজনীয় জাহাজের চাহিদাপত্র প্রদান করে। ডব্লিউটিসি সিরিয়ালভুক্ত জাহাজ থেকে উক্ত পণ্যের এজেন্টের বিপরীতে বরাদ্দপত্র ইস্যু করে। লোকাল এজেন্ট জাহাজের যোগান দেয়। ভাড়া পরিশোধ প্রক্রিয়া পণ্যের এজেন্ট ডব্লিউটিসিকে পরিশোধ করে। ডব্লিউটিসি লোকাল এজেন্টের বরাবরে ভাড়ার টাকার চেক ইস্যু করে। জাহাজ মালিক লোকাল এজেন্ট থেকে ভাড়ার টাকা পেয়ে থাকেন।
ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি শুরুতে বেশ গ্রহণযোগ্য থাকলেও পরবর্তীতে নানা অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জাহাজ মালিকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, বিপুল অংকের টাকা আটকে থাকাসহ নানা অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মুখে ভেঙ্গে যায় ডব্লিউটিসি। জাহাজ মালিকদের একাংশ ডব্লিউটিসির কারণে দুর্নীতি এবং বঞ্চনা বৃদ্ধি পাচ্ছে মর্মে অভিযোগ তুলে নতুন করে গঠন করে আইভোয়াক নামের পৃথক একটি প্লাটফর্ম। যেখান থেকে আমদানিকারকদের জাহাজ বরাদ্দ দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এই কার্যক্রমও সফল হয়নি।
জাহাজ মালিকদের তিন সংগঠনের বিরোধ, অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মাধ্যমে গত প্রায় এক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন রুটে বিশৃক্সখলা দেখা দেয়। বহু জাহাজ মালিক ভাড়া যোগাড় করতে পারছিলেন না। আবার অনেকেই নির্ধারিত ভাড়ার বহু কমে পণ্য পরিবহন করে কোনোরকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছিলেন। অনেক মালিক জাহাজ বিক্রি করে দেন। অনেকেই খরচ যোগাতে না পেরে জাহাজ স্ক্র্যাপ করে ফেলেন বলেও জানানো হয় মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে জাহাজ মালিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তর একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু এই প্রজ্ঞাপনের বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে জাহাজ মালিক সংগঠনগুলো আবারো বিরোধে জড়ায়। ওই প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসি গঠন করে সিরিয়াল প্রথা চালু করে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল এবং পণ্য পরিবহনের কথা বলা হয়। ঢাকা থেকে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ জাহাজ মালিকদের সংগঠনের শীর্ষ নেতারা চট্টগ্রামে এসে সভা করেন। ওই সভা থেকে বিডব্লিউটিসিসির কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও ব্যাপক হট্টগোলে তা সম্ভব হয়নি। এরপর জাহাজ মালিকদের তিন সংগঠন নানাভাবে আলাপ আলোচনা করে।
বিসিভোয়ার সভাপতি সাঈদ আহমদ, কোয়াবের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মেহেবুব কবির এবং আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে মাননীয় নৌ উপদেষ্টা এবং নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আসলে উনারা তিন সংগঠনকে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে সাধারণ জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকের কথা চিন্তা করে একই সিরিয়ালে জাহাজ চালানোর ব্যাপারে একমতে আসার জন্য অনুরোধ জানান।
তারা বলেন, দেশব্যাপী পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়লে দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়। সবকিছু মিলে জাহাজ মালিকদের তিন সংগঠন ঐক্যমতে পৌঁছে আজ (গতকাল) চুক্তিনামা স্বাক্ষর করলো এবং আগামী সোমবার থেকে সিরিয়াল প্রথার মাধ্যমে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল শুরু হবে।
বিসিভোয়ার সভাপতি সাঈদ আহমদ, সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহেবুব কবির কোয়াবের পক্ষে চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মেহেবুব কবির, জেনারেল সেক্রেটারি খুরশিদ আলম এবং আইভোয়াকের পক্ষে সভাপতি হাজী শফিক আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) আজিজুর রহমান চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন।
কমিটি গঠন : বিডব্লিউটিসিসি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিসিভোয়ার পক্ষ থেকে সাইদ আহমেদকে কনভেনার, সদস্য হিসেবে কামাল হোসেন ও মাসুদ করিম কোয়াবের পক্ষ থেকে ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির, খুরশিদ আলম ও অমল মিত্র এবং আইভোয়াকের পক্ষ থেকে হাজী শফিক আহমেদ, আজিজুর রহমান ও বেলায়েত হোসেনকে নিয়ে নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। সিরিয়াল প্রথা চালু করার ব্যাপারে জাহাজ ভাড়ার বিষয়টি শুরু থেকে বেশ আলোচিত ছিল। আমদানিকারকদেরও শংকা রয়েছে ভাড়া নিয়ে। আগামী রোববারের মধ্যে নতুন একটি ভাড়ার হার নির্ধারণ করার কথা রয়েছে।
এই ব্যাপারে আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে ভাড়া যাতে কোনোভাবেই বৃদ্ধি করা না হয় সে ব্যাপারে বলা হয়েছে। বিসিভোয়া এবং কোয়াবও ভাড়া যৌক্তিক রাখার চেষ্টা করার কথা বলেছে। সামগ্রিকভাবে জাহাজ মালিকদের বর্তমান দুরবস্থা এবং আমদানিকারকদের আমদানি ব্যয় সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে জাহাজ ভাড়া নির্ধারণ করা হবে বলেও তিনি জানান।