একদিন আমি আমার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মেঘ উড়িয়ে দিয়ে সোনালী রোদ্দুর হ‘বো। মুক্তো দানার মতোন রাশি রাশি খুশি ছড়াবো। ফিরে যাবো আমার রঙিন কৈশোর ও দুরন্ত যৌবনে। যেখানে থাকবে, হাডুডু, বৌ–চি, কাবাডি, গোল্লাছুট, রুমাল চোর, চোর –পুলিশ, টারজান –টারজান খেলা, পুতুল বিয়ে, চড়ুইভাতি ইত্যাদি মজার আয়োজন।
পাড়ার সমবয়সী যে কোন বাড়িতে বিনা নিমন্ত্রণে নির্দ্বিধায় অনানুষ্ঠানিক খাওয়া দাওয়া হবে। পাড়ার ছেলেমেয়ে, বুড়ো বুড়ি নির্বিশেষে বড় দীঘির জলে হবে সবার অবাধ সন্তরণ। আহা, কি উচ্ছ্বাস! কি অসাধারণ জীবনীশক্তি সকলের! কস্মিনকালেও পাড়ায় বড় কোন রোগের নাম শোনা যাবে না। দস্যি মেয়ের দল নিয়ে ছুটে বেড়াবো ফসলের মাঠে, সোনালী ধানের শীষের দোলায় দোল জাগাবো, ডানপিটে সহযোদ্ধাদের সাথে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে গোধূলি পেরিয়ে গেলে চুপি চুপি বাড়ি ফিরবো। ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’ এর কল্যাণে সন্ধ্যার পরে স্কুলের মাঠে টকি সিনেমার আয়োজন হলে, আহা! কি আনন্দ হবে! পড়াশোনা নেই।
চট বা চালের বস্তা বগলদাবা করে ছুটে যাবো স্কুলের মাঠে, সবার আগে বসা চাই। কি বড় বড় ছবি দেখা হবে! সে এক বিশাল উৎসবমুখরতা! এই মাধ্যমেই সহজে স্যালাইন বানানো শেখানো, জন্ম–নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রচার, সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। মাঝে মাঝে আমাদের চমকে দিয়ে পর্দায় আমাদের অজান্তে তোলা কোন এক সময়ের ছবিও ডিসপ্লে করা হবে, যা বিশেষ আনন্দদায়ক বটে। জনপ্রিয় অভিনেতা–অভিনেত্রীদের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সচেতনতামূলক নাটক প্রদর্শন করানো হবে। মহানন্দে কেটে যাবে ভালো কিছু সময়। সাঙ্গ হলে সন্তুষ্ট মনে বাড়ি ফিরবো।
কতদিন জোনাকি দেখা হয় না। পথভ্রষ্ট জোনাকীদের আবার ফিরাবো তাদের চেনা প্রান্তরে। রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ওরা গাইবে ওদের সেই চেনা কোরাস। আমি রাত্রির কাছে কান পেতে শুনবো দূর, বহুদূর হতে ভেসে আসা মাতাল বাঁশির সুর। রাত্রির তৃতীয় প্রহরে হঠাৎ খেয়ালে আবৃত্তি করবো নজরুলের ‘অভিশাপ’। বুঝবে সেদিন বুঝবে..যেদিন আমি হারিয়ে যাবো.. বুঝবে সেদিন বুঝবে…। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই যথারীতি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হ‘বো। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক ঠকঠক অবিরাম বেরসিক করাঘাত। অগত্যা উঠে দরজা খুলেই মাতৃ–দর্শন। যথারীতি সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বো, হিসেব মতে মা‘কে আমার সাথে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হবে আমাকে জড়িয়ে, এ আমাদের পুরানো চুক্তি। মন ভরলে পরে শয্যা ত্যাগ করবো। মন কেন কাঁদে! যে জীবনে সোনালি ধানের শীষ দোল জাগায় না, যে জীবনে পাখির কলরব নেই, যে জীবনে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি নেই, নেই প্রতিবেশীদের সাথে বে–হিসাবী যোগাযোগ – এ কেমন জীবন! প্রতিদিনই সকাল আসে, দরজায় আর সেই প্রত্যাশিত বেরসিক ঠকঠক ঠকঠক আওয়াজ পাওয়া যায় না, দেখা হয় না মাতৃ–দর্শন, চুক্তি অনুযায়ী কেউ আর আমায় জড়িয়ে ধরে সুখ ঘুম দেয় না। প্রাণহীন জীবন নিয়ে এ কেমন বেঁচে থাকা!