আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই মেঘছোঁয়া তিনটি তাল গাছ। এগাছগুলোর ছায়াতে মিশে আছে আমাদের শৈশব। গ্রীষ্ম আমাদের শৈশবকে দিতো আমের রং, বর্ষা দিতো রংধনুর সাত রং, তালপাতায় আটকে যেত শরতের খন্ডীভূত মেঘ, হেমন্ত দিত চোরাধানের খই ফোটানোর মুহূর্ত। শীতে পুকুর পাড়ে বিরাজ করতো নিস্তব্ধতা আর বসন্তে হতাম পুকুর পাড়ের নিজস্ব বানর।
গ্রীষ্মে সূর্যিমামা যখন অনেক রাগান্বিত হতো, আমরা মুর্তাগাছের বোনা শীতল পাটি আর তুলার বালিশ নিয়ে পুকুর পাড়ে ঘুমের ভান ধরতাম, ছড়া কাটতাম, বানিয়ে বানিয়ে কিচ্ছা বলতাম, উত্তরে বাতাস আমাদের অর্ধলঙ্গ দেহগুলো জুড়িয়ে দিতো। আকাশ যখন আমাদের বকাবকি আর ধমক দিতো, আমরা দৌড়ে ছুটতাম আপন আপন গৃহের দিকে।
বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি আমাদের উঠান–ঘাটা সব হাঁটু–কাদায় ভরে দিত। বৃষ্টি বিরতি নিলেই আমরা চলে আসতাম এই রত্নে। তালগাছগুলোর একটু পশ্চিমেই ছিল পুকুরে শুয়ে থাকা এক বিশাল দেহের শিশুগাছ। একটানা বৃষ্টির পানি যখন পুকুরের পাড় ছুঁয়ে দিত, আমরা কেউ উলঙ্গ কেউ আধা জামা কেউবা লুঙ্গি গুছ মেরে সেই গাছটির একদম মাথা থেকে লাফ দিতাম। পুকুরে, গা’র ঝরা পানিতে গাছটি পিছল হয়ে যেতো, বহুবার প্রস্তুতির আগেই পড়ে যেতাম। পানি যখন অতিরিক্ত ঘোলা হয়ে যেত, মালিক বাবুর দৌড়ানি খেয়ে বিলে বিলে ছুটে বেড়াতাম।
দীর্ঘ খজু তালগাছগুলোতে প্রচুর তাল ধরতো। তালপাড়ার সময় ছেলেমেয়েদের ঢল, নির্জনে পাকাতাল কুড়িয়ে আনার মুহূর্তগুলো ছিল অন্যধরনের। কেউ খুব ভোরে কেউ রোদেলা দুপুরে কেউ বা অপরাহ্নে কুড়িয়ে আনতো ঝরে পড়া তাল। সেই তালেরই পিঠা খেতাম তালতলে বসে। দু–পা লম্বা করে দু হাত পিছনের মাটিতে ঠেক লাগিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকতাম, কখন ঝরবে একটা তাল। নিচ থেকে মনে হতো আকাশের মেঘ ছিটকে পড়ে তাল পাতায় গেঁথে আছে। পুকুর পাড়ের ঝোঁপগুলোতে ফুটতো নানা রঙের ফুল, সে ফুলে প্রকৃতি সাজতো, সাজতো গ্রাম্য খুকিরা।
ধোঁআশা পুকুর পাড়। একদিকে ঘনঘন আগুন জালাতাম অন্যদিকে শীতের আভাস,এই মুহূর্তগুলো ছিল অমল্য। কৃষকদের উৎসবের আগেই আমাদের পুকুর পাড়ের উৎসব শুরু হয়ে যেতো। আমরা একদল শুকনো পাতা শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে আনতাম। অন্যদল যেত ধান ক্ষেতে। তারা দু–চার মুঠো পাকা ধানের শিষ নিয়ে আসত, আমরা গোলাকার করে পাড়ের দরদমাখা মাটিতে বসতাম। গ্রামের সাহসী ছেলেটা আগুনের উপরে ধরে রাখত চোরাই ধানের শিষ। মুহূর্তের মধ্যেই গোলাবারুদের বিকট শব্দে আমাদের পুকুর পাড় হৈহুল্লোড়ে মেতে উঠত। ধান ফেটে বেরিয়ে আসা সেই দগ্ধ সোনার খই আমরা কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেতাম। হাঁটুজল পানিতে নেমে পুকুরের মিঠাপানি খেতাম। হেমন্তের সেই পুড়া ধানের ধোঁয়া দিগন্ত ছুঁয়ে দিতো।
শীতের সকালে পুকুর পাড় উধাও হয়ে যেতো। দেখা যেতনা সেই তালগাছ গুলো, তবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে প্রায় দানবের মতো ভয়াবহ দৃশ্য দেখতাম। পুকুর পাড় আমাদের করুণার সুরে ডাকতো, তাকে যেন কোন মস্ত চাদরে ঢেকে দিই, আমরা মুখ থেকে ধোঁয়া পাঠাতাম তার দিকে, যেন সেও একটু উষ্ণতা অনুভব করে।
অবশেষে বসন্তে প্রকৃতি সাজতো নতুনরূপে। গাছে গাছে নতুনপাতা, কেটে যেত পুকুরপাড়ের নীরবতা। আবারও আমরা দল বেঁধে আসতে শুরু করতাম পুকুর পাড়ে। এমন কোন গাছ ছিল না যার ডালপালাতে আমরা দোল খায়নি। বহুবার ডাল ভেঙ্গে পড়ে বিচানার প্রাণ জুড়িয়ে দিতাম। সারাদিন কেটে যেত গ্রামীণ নানা খেলায়; পদ্ম খেলা, সী খেলা, এই খেলাগুলো গাছের সাথে সম্পৃক্ত। এছাড়াও খড়ের পালার উপর কুস্তি লড়াই, কাবাড়ি খেলাই ও মগ্ন থাকতাম, বহু খেলা মস্তিষ্ক থেকেই বিলুপ্তপ্রায় নাম বলা মুশকিল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে কোকিলের মধুমাখা গান শুনতাম, আমরাও কোকিলের সাথে ভাব জমাতে চাইতাম কুহু কুহু বলে।
আহ!
আজ পুকুরপাড় ঠিকই আছে কিন্তু নেই একদল দস্যি ছেলেমেয়ে, পাটি বালিশ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি নেই। পুকুরের পানি ঘোলা করে না, মালিকবাবু নিস্তব্ধঘরে। তাল ঝরে পড়ার অপেক্ষা নেই। শুকনো পাতা ডালপালা এখনো পড়ে আছে। ধানের শিষগুলো অভিমানে নুয়ে আছে। কিছু কিছু গাছ শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। সেও ধোঁয়ার অপেক্ষায় থাকে না আর। কোকিলটা প্রহর গুণে কখন তার প্রতিধ্বনি শুনা যাবে। আধুনিকতার গহ্বরে তলিয়ে গেল আমাদের সোনাঝরা শৈশব। ঋতুর সাথে সাথে ভীতু হয়ে গেল পুকুরপাড়। সে হারিয়ে ফেলেছে ভাষা, ওগো সোনার পুকুর পাড়! আমাদের একটিবার ডাকো, শুধু একটিবার।