কক্সবাজার শহরের পাশের দ্বীপ সোনাদিয়া। দ্বীপটির একপাশে বিস্তীর্ণ ঝাউবন, অপরপাশে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বাগান। দ্বীপের চারিদিকে সাগরের লবণাক্ত পানি। এই দ্বীপে নেই মিষ্টি পানির জলাভূমি। ফলে এত উদ্ভিদ থাকার পরও হাতেগোনা সামান্য কিছু পাখি ছাড়া দ্বীপটিতে বড় কোনো পশু–পাখির দল বাস করতে পারে না। তবে দ্বীপটিতে একটি মিঠা পানির জলাভূমি গড়ে তোলা হলে এর প্রাণবৈচিত্র্যে যাদুকরী পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক অথবা নূনিয়াছড়া থেকে মাত্র এক মাইল চওড়া একটি নদী মোহনা পার হলেই সোনাদিয়া দ্বীপ। দ্বীপটি পূর্ব–পশ্চিমে প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ আর প্রায় এক কিলোমিটার চওড়া। একটি ছোট নদী মহেশখালীর কুতুবজোম থেকে সোনাদিয়াকে বিচ্ছিন্ন করেছে। দ্বীপটিতে বাস করে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। মূলত দ্বীপের দক্ষিণ–পশ্চিম অংশের বালিয়াড়িকে ঘিরেই গড়ে ওঠেছে সোনাদিয়ার জনবসতি। বিস্ময়করভাবে এখানকার বালিয়াড়ির ১০ ফুট নিচেই পাওয়া যায় সুপেয় মিষ্টি পানি। স্থানীয়রা টিউবওয়েল দিয়ে এই পানি তুলে দৈনন্দিন কাজে লাগায়। আর এই পানি যেন ‘সোনা’র চেয়েও দামি। কিন্তু বালিয়াড়ির সাগর তীর ছাড়া এই স্তরে আর সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। সোনাদিয়ায় বালিয়াড়ির ১০ ফুট নিচেই সুপেয় মিষ্টি পানি পাওয়া গেলেও চৈত্র–বৈশাখের খরায় ভূ–গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যায় এবং মিঠা পানির স্তরে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত লবণ ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। এছাড়া পানীয় জলের অভাবে দ্বীপটিতে পশু–পাখির মৃত্যু হতে পারে বলে মনে করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, দ্বীপটির একপাশে বিস্তীর্ণ ঝাউবন ও অপরপাশে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের একক প্রজাতির বাগান, দ্বীপটিকে পরিবেশগতভাবে করেছে ভয়ংকর রুক্ষ। ফলে দ্বীপটিতে হাতেগোনা কিছু মৌসুমী পাখি আসা–যাওয়া করলেও এখানে প্রাণবৈচিত্র্য নেই বললেই চলে।
কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মাঈনুদ্দিন সাহেদ বলেন, পুরো সোনাদিয়া দ্বীপ ঘুরে কয়েকশ পাখিও দেখা যাবে না। অথচ সোনাদিয়ার চেয়ে অনেক ছোট এলাকা হওয়ার পরও দরিয়ানগরে শত শত পাখি দেখা যায়।
সোনাদিয়ায় একটি মিঠা পানির জলাভূমি গড়ে তোলা হলে এর প্রাণবৈচিত্র্যেও যাদুকরী পরিবর্তন আসবে এবং কৃষি জমিগুলোও বহুবর্ষজীবী জল ধারণের ক্ষমতা অর্জন করবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী।
বিজ্ঞানীরা বলেন, ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্রে জলাভূমির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে মিঠা পানির জলাভূমি মাটির উপরে বৈচিত্রময় প্রাণের সমাবেশ ঘটায়; মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে, মাটির নিচের আদর্শ রসায়ন ও ভূ–গর্ভস্থ পানীয় জলের মজুদ ঠিক রাখতে সহায়তা করে। বিনোদন ও পর্যটনের জন্যও জলাভূমির গুরুত্ব অতুলনীয়।
‘ইকোসিস্টেমস’ বা বাস্তুতন্ত্র হল– উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, পানি এবং অণুজীবগুলি যেখানে একসাথে বসবাস করে এবং অস্তিত্বের জন্য একে অপরের উপর নির্ভর করে। বাস্তুতন্ত্র বন্য গাছপালা এবং প্রাণীদের বাসস্থান সরবরাহ করে, বিভিন্ন ফুড চেইন ও খাবারের ওয়েবগুলোকে ঠিক রাখে। প্রয়োজনীয় পরিবেশগত প্রক্রিয়া ও জীবন ধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। জৈব ও জৈব উপাদানগুলোর মধ্যে পুষ্টি পুনর্ব্যবহারের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। বাস্তুতন্ত্র জলচক্র, কার্বন চক্র, অক্সিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র ও শক্তি চক্রসহ একই বাস্তুতন্ত্রের শক্তির যথাযথ প্রবাহ বজায় রাখে। একটি পুকুর বা কুয়াকে কেন্দ্র করেও স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠতে পারে। পৃথিবীতে মূলত ৬ ধরনের বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। এগুলো হল বনভূমি, তৃণভূমি, মরুভূমি, মিঠা পানি ও সামুদ্রিক পানির জলাধার এবং আর্কটিক টুন্ড্রা। আর এই বাস্তুতন্ত্রের ‘প্রাণ’ হল জলাভূমি।
পরিবেশগত পূনরুদ্ধারের জন্য সোনাদিয়া দ্বীপে একটি মিঠা পানির জলাভূমি গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর (অব.) নুরুল আবছার বলেন, প্রস্তাব পেলে অবশ্যই বিষয়টি আমরা বিবেচনা করব।