লাখো আশেক ভক্তের উপস্থিতিতে ‘আল্লাহু আল্লাহু’ ধ্বনিতে সম্পন্ন হলো ফটিকছড়ি মাইজাভাণ্ডার দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হযরত মওলানা শাহ ছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এর ১১৯তম বার্ষিক ওরশ শরীফ। এবার শুক্রবার ওরশের প্রধান দিবস হওয়াতে জুমার নামাজের সময় অংশগ্রহণ করেছেন কয়েক লাখ মানুষ। রাতে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মনজিলের ওরশ শেষ হয়েছে। দেশজাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে গাউছিয়া আহমদিয়া মনজিলে মোনাজাত পরিচালনা করেন সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (ম.), ডা. সৈয়দ দিদারুল হক মাইজভাণ্ডারী (ম.), গাউছিয়া হক মনজিলে মোনাজাত পরিচালনা করেন সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভাণ্ডারী (ম.) প্রমুখ সাজ্জাদানশীনগণ।
ওরশে রওজা শরীফ গোসল, গিলাফ ছড়ানো, মিলাদ ক্বেয়াম, আলোচনা সভা, উন্মুক্ত তবারুক বিতরণ, সেমা মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফস্থ বিভিন্ন মনজিল।
গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিল (শাহ এমদাদীয়া) : লাখো ভক্তের উপস্থিতিতে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক হযরত গাউছুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এঁর ১১৯তম বার্ষিক ওরশ। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিলের সাজ্জাদানশীন হযরত মওলানা শাহছুফী সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী। মোনাজাতে দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন তিনি। সাজ্জাদানশীন হযরত মওলানা শাহসুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারীর আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় এবং নায়েব সাজ্জাদানশীন ও মোন্তাজেম সৈয়দ ইরফানুল হক মাইজভাণ্ডারীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর ওরশে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাইজভাণ্ডারে আসেন আশেক–ভক্তরা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, চায়না, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ওমানসহ নানা দেশ থেকে অসংখ্য ভক্ত–অনুরক্ত অংশ নিতে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে আসেন।
সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী বলেন, মহান আল্লাহর অলিগণের কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে। ইসলামের ক্রাান্তি লগ্নে সবসময় সুফীসাধকরাই ধর্মের আধ্যাত্মিক ও শরীয়তের অবকাঠামোর রক্ষকের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়েছেন। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের পাশাপাশি ইসলামের মৌলিক আদর্শ ও বিশ্বাসের সাথে সমাজ সংস্কৃতির নৈতিক সংস্কারে আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভের কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন। নায়েব সাজ্জাদানশীন সৈয়দ ইরফানুল হক মাইজভাণ্ডারী বলেন, সুফি দর্শন মানবতার শিক্ষায় আলোকিত পথ দেখায়। মাইজভাণ্ডারী তরিকার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের আত্মিক উন্নতি, নৈতিক মানোন্নয়ন এবং সামাজিক শান্তি ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠা করা। আমরা ওরশের মাধ্যমে শুধুমাত্র স্মরণ করি না, বরং সমাজে মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করার প্রতিজ্ঞা করি।
এসময় উপস্থিত ছিলেন ভারতের অধ্যাপক ড. শেখ মকবুল ইসলাম, খান এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দুল হক খান, ফনিঙ শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন সৈয়দ সোহেল হাসনাত, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী আলমগীর, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের উপ–ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু তাহের, শাহজাদা সৈয়দ এরহাম হোসাইন, শাহজাদা সৈয়দ মানাওয়ার হোসাইন। আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী (শাহ এমদাদীয়া) কেন্দ্রীয় কার্যকরী সংসদের সচিব শেখ মুহাম্মদ আলমগীরের পরিচালনায় ওরশে মিলাদ পরিচালনা করেন দারুত তায়ালীম প্রধান শিক্ষক মওলানা জয়নাল আবেদীন ছিদ্দিকী। মাইজভাণ্ডার ওরশ শরীফ সুপারভিশন কমিটির উদ্যোগে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ও ভিডিও চিত্র ধারনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্নস্থানে প্রয়োজনীয় গাড়ি পার্কিংসহ মেহমানদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে থাকা, সময়মতো জামাত সহকারে নামাজ আদায়, বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন, আলোকসজ্জা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধসহ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থা করা হয়।
এছাড়াও গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর ওরশ উপলক্ষে সাজ্জাদানশীন হযরত মওলানা শাহসুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (ম.)’র আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় এবং নায়েব সাজ্জাদানশীন, মাইজভাণ্ডারী ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ডিআইআরআই)’র ম্যানেজিং ট্রাস্টি সৈয়দ ইরফানুল হক মাইজভাণ্ডারীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ১০ দিন ব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী (শাহ এমদাদীয়া), মাইজভাণ্ডার ওরশ শরীফ সুপারভিশন কমিটি, দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ডিরি), মাইজভাণ্ডারী ফাউন্ডেশন, মাইজভাণ্ডারী এডুকেশন ট্রাস্ট, মাইজভাণ্ডারী শাহ এমদাদীয়া ব্লাড ডোনার্স গ্রুপ, মাইজভাণ্ডারী শাহ এমদাদীয়া স্বনির্ভরতা ট্রাস্ট, শাহ এমদাদীয়া অটো ড্রাইভিং স্কুল, প্রেমের তরী সুফি সংগীতালয়, মাইজভাণ্ডারী প্রকাশনী, গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হিফজুল কোরআন ফাউন্ডেশন, গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মাইজভাণ্ডার আহমদিয়া এমদাদীয়া মাদরাসা এবং অন্যান্য সহযোগী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো। ওরশ উদযাপন উপলক্ষে ভক্তদের নিরাপত্তা বিধান এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ ছাড়াও সাদা পোশাকে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। সুষ্ঠুভাবে ওরশ সমাপ্ত করতে সহযোগিতা করায় ফটিকছড়ি উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, স্বেচ্ছাসেবকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান সৈয়দ ইরফানুল হক মাইজভাণ্ডারী।
গাউছিয়া হক মঞ্জিল :
গাউসুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.)-র পবিত্র ওরশ শরীফ উপলক্ষে গাউসুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.), হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (ক.), হযরত সৈয়দ দেলাওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.)-র মাজার শরীফ জেয়ারত শেষে বাদে ফজর ইসলামী ঐতিহ্যের অনুসরণে, সুফী ঐতিহ্যের অনুসরণে শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)-র মাজার শরীফে গিলাফ চড়ানো, সুগন্ধি প্রদান করে আল্লাহতায়ালার দরবারে হাত তুলে সকলের পবিত্র আশা পূরণ করার জন্য ফরিয়াদ করেন বাংলাদেশের উপর রহমত কামনা করেন গাউসিয়া হক মনজিলের সাজ্জাদানশীন সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভাণ্ডারী (ম.)। তিনি শান্তিপূর্ণ একটি স্বচ্ছল জনপদ হিসেবে বাংলাদেশকে কবুল করার জন্য, সমস্ত আসমানি–জমিনী বালা–মুসিবত হতে এই জনপদকে হেফাজত করা, বিশ্ব মজলুমের মুক্তি কামনা, বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে যেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে, যুদ্ধ বিগ্রহে মানুষের জীবন অতিবাহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, মানুষ অন্যায়ের শিকার হয়ে পড়েছে, নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়েছে, হত্যার শিকার হয়ে পড়েছে, রব্বুল আলামীনের দরবারে সমস্ত অবিচার থেকে মানবজাতিকে হেফাজত করার জন্য তিনি ফরিয়াদ করেন। গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.)র যে সাম্যের আদর্শ–শান্তির আদর্শ, দিকে দিকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সকল আশেকানে গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.), মাইজভাণ্ডারী গাউসিয়া হক কমিটির সকলকে তৌফিক দান করার জন্য, গাউসিয়া হক মনজিল কর্তৃক এই মহান দিনে যে সমস্ত এন্তেজাম হয়েছে, এই এন্তেজামকে কবুল করার জন্য, যে তবারুকাতের এন্তেজাম হয়েছে, তবাররুকাতকে সকলের জন্যে রুহানি, বিমারীর জন্যে শেফা হিসেবে কবুল করার জন্য, এই আসা এবং যাওয়াকে, এই অবস্থানকে সকলের নাজাতের উসিলা হিসেবে কবুল করার জন্য তিনি মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ করেন। মাইজভাণ্ডার শরীফ গাউসিয়া হক মনজিলের ব্যবস্থাপনায় গৃহীত কর্মসূচি ১০ মাঘ রাত ১২টার কেন্দ্রীয় মিলাদ, কিয়াম ও মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়।
আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী : গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হজরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এর বার্ষিক ওরশ মহাসমারোহে মাইজভাণ্ডার দরবারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবছরও মাইজভাণ্ডার শরীফের সর্বপ্রধান ও সর্ববৃহৎ এই ওরশ শরীফ গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিলের মোন্তাজেম, জিম্মাদার ও সাজ্জাদানশীন, আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি শাহসুফি ডা. সৈয়দ দিদারুল হক মাইজভাণ্ডারী (ম.)-এর সার্বিক ব্যবস্থাপানায় অনুষ্ঠিত হয়। ডা. সৈয়দ দিদারুল হক মাইজভাণ্ডারী বলেন, নানা মত ও দর্শনে বিভক্ত–বিক্ষুব্ধ এই বিশ্বে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মাইজভাণ্ডারী দর্শন সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এসময় উপস্থিত ছিলেন শাহজাদা সৈয়দ হোসেইন রাইফ নুরুল ইসলাম রুবাব মাইজভাণ্ডারী, শাহজাদা ডা. সৈয়দ হোসেইন সাইফ নিহাদুল ইসলাম মাইজভাণ্ডারী ও আঞ্জুমানের খাদেমানবৃন্দ। ওরশ উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী নানাবিধ ধর্মীয় ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পালিত হয়। ৯ মাঘ বৃহস্পতিবার গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) রওজা শরীফে গিলাফ চড়ানো, গোলাপ নির্ঝরণী, মিলাদ ও মোনাজাতের মাধ্যমে ওরশ শরীফের আনুষ্ঠানিকতা সূচিত হয় এবং বাদ এশা মাইজভাণ্ডারী সাংস্কৃতিক পরিষদের উদ্যোগে জিকিরে সামা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল শুক্রবার প্রধান দিবসে দিনব্যাপী কোরআনখানি ও জিকির, দুপুর ১২ টায় মাইজভাণ্ডার শাহী ময়দানে কেন্দ্রীয় জুমার জামাত, বাদ এশা গাউছিয়া আহমদিয়া ভবন ময়দানে শানে বেলায়েত মাহফিল, রাত ১১ টায় গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) দোয়ার মেহরাব হতে মিলাদুন্নবী, তাওয়াল্লাদে গাউছিয়া ও আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত জায়েরীনদের মাঝে নেয়াজ তাবারুক বিতরণের মাধ্যমে ওরশ শরীফের কার্যক্রম শেষ হয়। ওরশ শরীফ সুপারভিশন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী নায়েব মোন্তাজেম শাহজাদা সৈয়দ হোসেইন রাইফ নুরুল ইসলাম রুবাব মাইজভাণ্ডারী বলেন, ওরশ শরীফের সমস্ত কার্যক্রম ও আয়োজনকে সফলভাবে সম্পন্ন করায় স্থানীয় প্রশাসন, নিরাপত্তা সংস্থা, এলাকাবাসী ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।