সৈকতে যাদের জীবন-জীবিকা

পিংকু দাশ | বৃহস্পতিবার , ১১ মে, ২০২৩ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীর দীর্ঘতম, নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। অফুরন্ত জলরাশি, বালুকাময় দিকচিহ্নহীন সৈকত, সমুদ্রের ঢেউ এসব প্রত্যক্ষ করার জন্য সৌন্দর্য পিপাসুরা বারবার ফিরে আসে সমুদ্রের টানে। অপরূপ সৌন্দর্যের মনোমুগ্ধকর সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে কক্সবাজার ভ্রমণে।

কর্মব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে অনেকেই ছুটে যান কক্সবাজার। সমুদ্রের নীল জল, আছরে পড়া ঢেউ মুহূর্তেই মানুষকে ভুলিয়ে দেয় সব দুঃখ কষ্ট। মানুষ অবসর কাটাতে সাগরের পানে ছুটলেও কিছু মানুষের জীবিকা কিন্তু এই সমুদ্রকে ঘিরেই। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তাদের বিরতিহীন কর্মব্যস্ততা চলতেই থাকে। সৈকতেই তাদের জীবন ও জীবিকা। বিচিত্র সব পেশার সমাহার এই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতেই। তাদের পেশার কারণে সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণ ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। পর্যটকদের সৌখিনতা, পর্যটন শহরে এদের অনেকের আয়ের উৎস।

পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কেউ সৈকতে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে, কেউ পর্যটকদের আরাম করে বসার ব্যবস্থা করে, এরকম আরও কত কী! ঘোড়ার পিঠে চড়ে সৈকত ভ্রমণের আনন্দ যারা দেয়, এদেরকে বলে কাচোয়ান। সৈকতে পুরনো পেশাগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টে এরকম শতাধিক ঘোড়া পর্যটকদের বিনোদন দিয়ে আসছে। অনেক লোকের কর্মসংস্থানও এই ঘোড়াকে ঘিরে। প্রায় দুই শতাধিক লোক এই পেশার সাথে জড়িত। সুগন্ধা পয়েন্টে এক কাচোয়ানের সাথে কথা বলে জানা গেছে একবার চক্কর দিলে ২৫০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। বাচ্চাদের ভীষণ পছন্দের একটি রাইড, ঘোড়ার পিঠে চড়ে সমুদ্র দেখা।

অত্যাধুনিক লেন্সযুক্ত ডিএসএলআর ক্যামেরায় ঝকঝকে ছবি তুলতে কার না ভালো লাগে। আর সেই ছবি যদি হয় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে তাহলেতো কথাই নেই। ভোরে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়, ক্যামেরা হাতে পর্যটকদের স্মৃতির সাক্ষী হতে অধীর অপেক্ষায় থাকেন। প্রতিদিন শতাধিক ফটোগ্রাফার পর্যটকদের ছবি তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। পর্যটকদের দেখলেই ছবি তুলে দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন তারা। নতুন বিবাহিত দম্পতি দেখলেতো কথাই নেই। তারাও চান সৈকতের আনন্দকে ফ্রেমবন্দী করে রাখতে। প্রতি ছবি তিন থেকে পাঁচ টাকা করে নেয় তারা। বিভিন্ন পোজের বিভিন্ন ঢংয়ের ছবি তুলতে অনুপ্রাণিত করেন এসব আলোকচিত্রী। অনেক সৌখিন পর্যটক সখ করে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে পছন্দ করেন। তারা দূর থেকে জুম লেন্স ব্যবহার করে ছবি তুলে বলে সমুদ্রের বিস্তৃত বালুকারাশিসহ ছবি তোলা যায়। যা দেখতেও অসাধারণ। ছবি তুলে তারা পর্যটকদের হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেন। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত তরুণও জীবিকার প্রয়োজনে এই কাজ করেন। পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষ এটি। একজন ফটোগ্রাফার প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। সৈকতে পর্যটকরা ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে একটু বসার জন্য আছে কিছু সৌখিন চেয়ার ছাতা, যেটাকে বলে কিটকট। প্রতিদিন কিছু লোক এই চেয়ারছাতাগুলো সরবরাহ করেন। ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া দিতে হয়। একসিট ঘণ্টায় ৩০ টাকা এবং দুই সিট ৬০ টাকা ভাড়া দিয়ে এখানে শুয়ে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকরা। এরকম একজন কিটকটওয়ালা, নাম রানা, তার সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে এক বছরের জন্য এই ছাতা সরবরাহ করার অধিকার পায়।

সৈকতে আরেক আকর্ষণীয় রাইড হচ্ছে বিচ বাইক। বাইক চালক সোহেল জানায়, সৈকতে এক রাউন্ড দিলে পর্যটকদের দিতে হয় ২০০ টাকা। বাইকে চালকের সাথে বসতে পারেন সর্বোচ্চ তিনজন পর্যটক। বালুচরের এপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অর্থাৎ একটু দূরে গেলেই দিতে হয় ৫০০ টাকা। বিচ বাইকের মত আরেকটা বাইক আছে, নাম ওয়াটার বাইক। কক্সবাজার সমুদ্রে কিছু ওয়াটার বাইক এই সেবা দিয়ে থাকে। পর্যটকরা লাইফ জ্যাকেট পরে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারেন। দারুণ রোমাঞ্চকর ভ্রমণ এটি। সমুদ্রতীর ছেড়ে হারিয়ে যাওয়া যায় সমুদ্রের অজানায়। নির্দিষ্ট দূরত্বে ঘুরে আসতে পর্যটকদের দিতে হয় ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত।

সৈকতে দেখা যায় রং বেরংয়ের কিছু টিউব (যেটাকে অনেকে বয়া বলে) ঢেউয়ের সাথে খেলা করে। ঢেউয়ের সাথে একবার তীরে আসলেও আরেক ঢেউয়ে সেটা আবার সাগরে চলে যায়। দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। ভাবছিলাম, এদের মালিক কই, যদি ঢেউয়ে হারিয়ে যায় টিউবগুলো! যেই টিউবগুলো একটু ধরার চেষ্টা করলাম, সাথে সাথে মালিক এসে হাজির। টিউব মালিক জানায় ঢেউয়ের সাথে সাথে আরাম করার জন্য আবার কেউ কেউ নিরাপদে সমুদ্রে স্নান করার জন্য টিউব ব্যবহার করেন। প্রতি ঘণ্টায় ৫০ টাকা দিতে হয়, একটা টিউব ব্যবহার করলে।

কক্সবাজারে গেলে শামুক, ঝিনুকের গয়না কিনেন না এমন পর্যটক নেই বললেই চলে। শতশত ছোটবড় অনেক হকার এই ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা সমুদ্রের শামুকঝিনুক কুড়িয়ে বাসায় নিয়ে গিয়ে পরিবারের সবাই মিলে এই গয়না তৈরি করেন, তাদের নিজস্ব ডিজাইনে। অনেক কম দামে সুন্দর সুন্দর শামুক ঝিনুকের গয়না, যে কারও মন কেড়ে নেয়। ঝিনুক, শামুক এবং পুতির হরেক রকমের মালা, ব্রেসলেট, কানের দুল, নেকলেস দৃষ্টিনন্দন এই গয়নাগুলো দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। সর্বনিম্ন ৩০ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামে নানা রকমের গয়না সত্যি অসাধারণ। সবাই নিজের জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার জন্য উপহারস্বরূপ এই গয়না কিনে নিয়ে আসেন। সমুদ্র সৈকতে যে মার্কেটটা আছে তার নামই হচ্ছে ঝিনুক মার্কেট যা পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ।

প্রতিদিন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত পর্যন্ত সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে হলুদ পোশাকধারী কিছু তরুণ অতন্দ্র প্রহরীর মত পর্যটকদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। তারা লাইফগার্ড হিসেবে পরিচিত। সাগরে নেমে বিপদে পড়াদের জীবন বাঁচানো তাদের কাজ। অনেকের জীবনজীবিকাও এটি। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পর্যটন কেন্দ্র নির্মিত হোটেল ছাড়াও বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে অনেক ছোট বড় হোটেল। সৈকতের নিকটেই আছে দুটি পাঁচতারা হোটেল এবং দামি দামি বেশ কয়েকটি হোটেল। যেখানে বিভিন্ন পদে চাকরি করে হাজার হাজার লোক।

প্রতিদিন অসংখ্য দেশিবিদেশি পর্যটক এই সৈকতে আসেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং বিভিন্ন লম্বা ছুটিতে উপচে পড়া পর্যটক সাগরের লোনা জলে আনন্দ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় টুরিস্ট পুলিশ সজাগ দৃষ্টি রাখেন।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। অনেক লোকের কর্মসংস্থান এবং বেকার সমস্যার সমাধান করে দেশের দারিদ্র বিমোচনে অনন্য ভূমিকা পালন করে সৈকতকেন্দ্রিক বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বোয়ালখালী হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহিলিয়াম খামে প্রেম
পরবর্তী নিবন্ধবখতিয়ার কাকীর ঐতিহাসিক দরগায় শেষবিশ্রামে সাধক-শাসক যারা