সৈকতে কেন এই মৃত্যু

কক্সবাজার প্রতিনিধি | শুক্রবার , ১৩ জুন, ২০২৫ at ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে পানিতে ডুবে মৃত্যু যেন থামছে না। একের এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলছে। সর্বশেষ ঈদুল আজহার ছুটিতে সাগরে নেমে আনন্দউচ্ছ্বাস করতে গিয়ে পানিতে ভেসে গিয়ে দুই দিনের ব্যবধানে তিন পর্যটকসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তীরের কাছে গোসল করতে নেমে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাওয়া পুত্রকে বাঁচাতে গিয়ে পিতাপুত্র দুইজনই মারা যাওয়ার মতো মর্মস্পর্শী ঘটনাও ঘটেছে এসময়।

এই মৃত্যুর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা নিজেরাই দায়ী বলে দাবি করছেন লাইফগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা। নির্দেশনা না মেনে সাগরের গভীরে চলে যাওয়া ও নিষিদ্ধ পয়েন্টে নেমে গোসল করা এসব মৃত্যুর পেছনের অন্যতম কারণ। এছাড়া সমুদ্রে গোসলের সময় সতর্ক না থাকা, নির্দেশনা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং সৈকতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতিও এর জন্য দায়ী।

জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল সূত্রে জানা গেছে, এবারের ঈদুল আজহার ছুটিতে কঙবাজার বেড়াতে এসে সমুদ্র গোসল করতে নেমে পানিতে ভেসে গিয়ে তিন পর্যটক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এছাড়া একইভাবে আরো দুইজন স্থানীয় লোকের মৃত্যু হয়েছে। গত ৮ জুন থেকে ১০ জুন দুই দিনের মধ্যে এসব অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, ১২০ কিলোমিটারের এই সৈকতের মাত্র ৩ কিলোমিটারে (কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত) দুর্ঘটনায় উদ্ধার তৎপরতা চালানো জন্য বেসরকারি একটি সংস্থার ২৭ জন কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। অবশিষ্ট ১১৭ কিলোমিটার সৈকত অরক্ষিত পড়ে থাকছে। বিশেষ করে টেকনাফ, বাহারছড়া, পাটুয়ারটেক, ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, কলাতলী, শৈবাল ও মাদ্রাসা পয়েন্টের সৈকতে কেউ গোসলে নেমে নিখোঁজ হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর কেউ নেই।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিসেইফ লাইফ গার্ডের ইনচার্জ সাইফুল্লাহ সিফাত জানান, কঙবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার স্থানে পর্যটকদের বিচরণ রয়েছে। তবে এই তিন কিলোমিটারের মধ্যেও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। যেখানে রয়েছে গুপ্তখাল ও চোলাবালি। এর মধ্যে সিগাল পয়েন্ট, ডিভাইন পয়েন্ট ও লাবণীর দক্ষিণে একটি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে এসব স্থান চিহ্নিত করে সেখানে পর্যটকদের পানিতে না নামতে নিষেধ রয়েছে। কিন্তু বহু পর্যটক নিষেধ না মেনে সেখানে নেমে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অধিকাংশ পর্যটক নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গিয়ে সাগরে অসতর্ক অবস্থায় গোসল করে। এসময় ঢেউয়ের আকস্মিক তোড়ে গভীর সাগরে ভেসে যায়। এসময় লোকজন বেশি থাকায় লাইফগার্ড কর্মীরা দ্রুত খবর পায় না। খবর পেয়ে উদ্ধার করতে করতে মৃত্যুর মুখে পতিত হয় অনেকে। অনেকে আবার ভাটার সময়েও নিষেধাজ্ঞা না মেনে গোসলে নামে। তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত আপ্রাণ চেষ্টা করি, মাইকিং করি, পতাকা পাতানো হয়। তারপরও অধিকাংশই এসব তোয়াক্কা করে না। আর স্বল্প জনবল নিয়ে বিপুল সংখ্যক লোককে জনে জনে বলা বা সাগর থেকে তুলে আনা আমাদের পক্ষে সম্ভবও হয় না।

সমুদ্র সৈকতে কর্মরত বিচকর্মীদের দলনেতা মাহবুবুল আলম বলেন, শুধু লাইফগার্ড নয়, বিচকর্মীরাও প্রতিনিয়ত সমুদ্রে নেমে গোসলসহ যাবতীয় বিধিনিষেধ নিয়ে পর্যটকদের সতর্ক করে। এসব বিধিনিষেধ বিষয়ে বারবার তাগাদা দিই। কিন্তু অধিকাংশই এসব তাগাদা বা নিষেধ মানে না। ফলে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে।

সিসেফ লাইফগার্ডের তথ্য মতে, স্রোতের টানে ভেসে কিংবা গুপ্তখালে আটকা পড়ে গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মারা গেছেন পাঁচজন পর্যটক। এর আগের ৬ বছরে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে মারা গেছেন ৪৯ জন পর্যটক।

জানতে চাইলে কঙবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাফিস ইনতেসার নাফি বলেন, সমুদ্রে নামার আগে থেকেই জোয়ারভাটার তথ্য সবার জেনে নেয়া উচিত। সৈকত প্রশাসন প্রতিটি বৈরী আবহাওয়ায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে সতর্ক সংকেত ও সংখ্যা দিয়ে বিপদের মাত্রা সম্পর্কে অবহিত করা হয় জনসাধারণকে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই সংকেত বা সংখ্যার অর্থ অনেকেই জানেন না। কোন রঙের পতাকা কি অর্থ বহন করছে সে বিষয়ে অনেকেরই কোনো স্পষ্ট জ্ঞান নেই।

মানতে হবে যেসব নির্দেশনা : . সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে লাইফ গার্ড কর্মীরা লালহলুদ এবং লাল পতাকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলো কখন ও কোথায় সমুদ্রের পানিতে যাওয়া নিরাপদ তার নির্দেশনা বহন করে। লাল রঙের পতাকা মানে সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। আর লালহলুদ পতাকার অর্থ সমুদ্রে গোসল করা নিরাপদ। গোসলের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে লালহলুদ পতাকা লাগানো জায়গাগুলোতে থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই লাল পতাকা লাগানো জায়গা অতিক্রম করা যাবে না।

. রিপ কারেন্ট হল ঢেউয়ের শক্তিশালী অবস্থা যখন তা সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়। এই ঢেউ যেকোনো দক্ষ সাঁতারুকেও খঁড়কুটোর মতো দ্রুত সমুদ্রের গভীরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এসময় কোনোভাবেই সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না। যথাসম্ভব আগে থেকেই লাইফ গার্ড কর্মীদের কাছ থেকে রিপ কারেন্টের সময়ের ব্যাপারে জেনে নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ, সাগরে নামছেন আনোয়ারার জেলেরা
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার সৈকতে ভেসে গিয়ে পিতা-পুত্রের মৃত্যু