সেভেন সিস্টার্সকে রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় ভারত

চট্টগ্রামে গোলটেবিল বৈঠকে সারজিস আলম সুন্দর দেশ গড়তে জাতীয় ঐক্যের বার্তা চরমোনাই পীরের

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

আধিপত্যবাদের সকল ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত রেখে চট্টগ্রামকে নিরাপদ রাখতে পারলে পুরো বাংলাদেশ নিরাপদ থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গতকাল শনিবার বেলা ১২টায় নগরীর পলোগ্রাউন্ড মাঠে ‘ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিরোধ, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান এবং বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনার আয়োজন করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগর। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের আহ্বান জানান সবাই। এ সময় ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে সারজিস আলম বলেন, সেভেন সিস্টার্স রক্ষা করার জন্যই ভারত একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। একাত্তরের আগে সংস্কৃতি, মতপার্থক্যসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে সেভেন সিস্টার্সে প্রায় বিদ্রোহ লেগে থাকত। তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে হবে যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, বরং নিজের সেভেন সিস্টার্সকে রক্ষা করার জন্য কীভাবে ভারত এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের তিন পাশে যেমন ভারত, তেমনি সে দেশটির এক পাশে মিয়ানমার, আরেক পাশে নেপালভুটান, পাশে চীন থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ভারতের মনে তখন এই ভয়টা এবং এই স্বার্থটা সবচেয়ে বেশি ছিল যে, এখন যদি এই সুযোগে আমি পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত না করতে পারি তাহলে কখন না আমি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাই। ভারত নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে পড়ে দাবি করে তিনি বলেন, সেই হুমকি একাত্তর থেকে শুরু করে চব্বিশের আগেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছিল।

সারজিস আলম বলেন, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম বিবেক বেঁচে দেওয়া দলান্ধ কোনো প্রজন্ম নয়। এই প্রজন্ম অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে। বিগত ১৫ বছরে ভারতের আধিপত্যবাদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে দাসত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুনি শেখ হাসিনা খুনের বিষয়ে কোনো অনুশোচনা না করে আরও দাম্ভিকতা প্রকাশ করেছে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত বাংলাদেশের মানুষের আবেগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। হাসিনার জন্য উপযুক্ত স্থান হলো বিচারের মঞ্চ। তাই তাকে দ্রুত ফেরত পাঠানোর দাবি জানান তিনি।

আলোচনায় প্রধান অতিথি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, বিগত দিনে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা নিজেদের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেছে। আমরা ইসলাম, দেশ ও মানবতার কল্যাণে রাজনীতি করি বলে কারো কোনো সহযোগিতা নিয়ে এমপিমন্ত্রী হতে রাজি হইনি। তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমরা ন্যায়ের পক্ষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নেমেছিলাম। কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সাথে বৈষম্য করা হচ্ছে। একটি সুন্দর দেশ গড়তে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে আমরা বারবার বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছি।

তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ না করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলে তা দেশবাসী মেনে নেবে না। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। ইসলাম, দেশ ও মানবতা রক্ষায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি মুহাম্মাদ জান্নাতুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমানের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগর আমির শাহজাহান চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি তাজুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আশরাফ উদ্দিন মাহদী, বিএনপি চট্টগ্রাম মহানগরের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সম্পাদক ডা. এস এম সরোয়ার আলম, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. মো. নাজিমুদ্দিন চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি, খেলাফত মজলিস চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অধ্যাপক খুরশিদ আলম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি হাফেজ জাকারিয়া, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চবি সমন্বয়ক আবদুর রহমান, গণঅধিকার পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইউসুফ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চট্টগ্রাম মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ আল মাদানী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল হক, জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগর সেক্রেটারি অধ্যক্ষ মো. নুরুল আমিন, চট্টগ্রাম মহানগর নেজামে ইসলামী পার্টির সভাপতি ফজলুল করীম জেহাদী, চবি শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আল ফোরকান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম সমন্বয়ক রিজুয়ান সিদ্দিকী, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ সভাপতি কাজী মজিবুর রহমান মুজিব, চবি শিক্ষক ড. হুমায়ুন কবীর খালুভী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির চট্টগ্রাম মহানগর সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগর সেক্রেটারি আল মোহাম্মদ ইকবাল এবং ইসলামী আইনজীবী পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাড. পারভেজ তালুকদার।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, ৫৩ বছরে শাসকেরা ভারতের গোলামি করেছে। তারা জনগণের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল করে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সাজাতে হবে। অন্যথায় জুলাই বিপ্লব সফল হবে না।

জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগর আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ভারত ৫৩ বছর নয়, ৮৩ বছর পর্যন্ত ধ্বংসের চক্রান্ত করছে। ভারতের সাথে ১৭ চুক্তি করা হয়েছে। এই ১৭ চুক্তি কি আমরা তা জানি না। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উদ্ধার হতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেন, ৫৩ বছরে দেশ ও জাতির কোনো মুক্তি হয়নি। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় আধিপত্যবাদকে ধ্বংস করতে না পারলে দেশের মানুষকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, এক দল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় ক্ষমতায় যেতে চায়, আরেক দল ভারতীয় আধিপত্যবাদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় থাকতে চায়। পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় সরকার হতে পারে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, সচিবালয়ে আগুন লেগে ফাইল পুড়ে যাওয়া প্রমাণ করে এখনো দেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ নিশ্চিহ্ন হয়নি।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাড. মো. নাজিমুদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাস্তাঘাটে বা ব্যক্তিগত যত না সমস্যা তার চেয়ে বেশি সমস্যা সচিবালয়ে। এটি ফ্যাসিজমের একটি অংশ। ফ্যাসিজমকে প্রশাসন থেকে দূরে রাখা সম্ভব না হলে সংস্কার কাজ ব্যাহত হবে।

বিএনপির চট্টগ্রাম মহানগর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সম্পাদক ডা. এস এম সরোয়ার আলম বলেন, ভারতের রাজনৈতিক আগ্রাসন আমাদের দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে হবে।

নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আশরাফ মাহদী বলেন, ভারতের নাট্যমঞ্চে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সাথে প্রহসন করা হয়েছে। যে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা নেই তাদেরকে আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চাই না।

গণঅধিকার পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ভারত থেকে হাসিনাকে বিতাড়িত করে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশে ভারতের নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

খেলাফত মজলিস চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অধ্যাপক খুরশিদ আলম বলেন, স্বল্প সময়ে ভারতীয় আধিপত্য দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য অবশ্যই আমাদেরকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি হাফেজ জাকারিয়া বলেন, ইসলাম, ঈমান নিয়ে যদি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা সম্ভব হয় তবে চব্বিশের জুলাই বিপ্লব সফল হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদ নির্মূল করতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে চৌকস সেনাবাহিনীর অফিসারদেরকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদকে রুখে দাঁড়াতে না পারলে আমরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারব না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল হক বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে নিয়োগ পরীক্ষায় যারা চাকরি প্রার্থী হয়ে বৈষম্যের শিকার হয়ে নিয়োগ পাননি তাদেরকে চাকরিতে নিয়োগ দিতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আল ফোরকান বলেন, একটি কল্যাণমূখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐক্য জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৫ দিন জনসংযোগ করবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপিকে নিয়ে অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে : ফখরুল