অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশে সেবা খাতে অনেক হয়রানি করা হয়। এতে লোকজনকে ঘোরানো হয়। তবে মানুষ চায় সেবা। ভালো সেবার ক্ষেত্রে কেউ সেবার মূল্য দিতে কৃপণতা করে না। তিনি বলেন, আমরা মানুষের জন্য কিছু করে যেতে চাই। কারণ, পরে যে সরকার আসবে সময় লাগবে, বুঝতে সময় লাগবে। আর সদিচ্ছার ব্যাপার আছে। এগুলোর মধ্যে যদি কিছুটা বাংলাদেশে আশার আলো দেখাতে পারি।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাল্টিপারপাস হলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল সহজ ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে ট্যাক্স রিপ্রেজেনটেটিভ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (টিআরএমএস) সফটওয়্যার উদ্বোধন উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি এনবিআর চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করলাম সুফল কি আমরা দেখে যেতে পারব? কারণ, আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসের পর চলে যেতে হবে, এর আগে কিছুটা দেখে যাব কি না। প্রধান উপদেষ্টা প্রায়ই আমাকে বলেন, কিছু কিছু কন্ট্রিবিউট করে যাই আমরা। তিনি বলেন, কন্ট্রিবিউট মানে বাইরে অনেক বিরাট, এই সেই অনেকেই চোখেও দেখে না। করলেও দেখে যে কিছুই হচ্ছে না।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞ মত হলো, দেশের অর্থনীতির নির্ভরতার একটা বড় অংশ হচ্ছে সেবা খাত। ব্যাংক, টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস কিংবা সরকারি–বেসরকারি অফিস প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেবা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ‘সেবা’ নিতে গিয়ে মানুষকে প্রায়শই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। ঘুষ, দালালি, অহেতুক বিলম্ব, ভোগান্তি, অমানবিক আচরণ কিংবা জটিলতা সৃষ্টি– এসব যেন সেবাগ্রহীতার চিরচেনা অভিজ্ঞতা। নামে ‘সেবা’ হলেও আমাদের দেশে সার্ভিস সেক্টর মূলত হয়রানি ও দুর্নীতির খাত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে– সেবা নিতে গিয়ে যদি হয়রানি বা ভোগান্তিই পোহাতে হয়, তাহলে কি সেটা আর ‘সেবা’ হিসেবে গণ্য করা যায়? সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসে সরকারি অফিসগুলো থেকে। বিশেষ করে একটি সনদপত্র বা লাইসেন্স সংগ্রহ করতে গিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘুরতে হয়। অনেকে বাধ্য হয়ে দালালের দ্বারস্থ হন। সেখানেও রয়েছে আর্থিক ভোগান্তির বিষয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, দুঃখজনকভাবে দেশে সরকারি সেবা খাতের দুর্নীতি যেন লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে দুর্নীতি দমনের কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য সর্বাগ্রে সরকারি কাজের ক্ষেত্রগুলো দুর্নীতিমুক্ত হওয়া জরুরি। সরকারি সেবা ঘুষ–দুর্নীতিমুক্ত না হলে নাগরিক তার ন্যায্য অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়, সামাজিক অসন্তোষ বাড়ে, অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশে সরকারি সেবা খাতের ভাবমূর্তি এমন দাঁড়িয়েছে যে এটি ঘুষ–দুর্নীতির অন্যতম আখড়া। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সিটিজেন পারসেপশন সার্ভেতে (সিপিএস) এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।
সেবা পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার– এতে কোনো ছাড় নেই। এটা কোনো দয়াও নয়। মনে রাখা দরকার সেবা প্রদানকারীরা জনগণের ট্যাক্সের অর্থে বেতন পান। তাই তাদের দায়িত্ব জনগণকে সম্মান ও সহানুভূতির সঙ্গে সেবা দেওয়া। নাগরিক যদি সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন, তাহলে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি তার আস্থা নষ্ট হয়। আমরা মনে করি, সেবা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই খাতটি দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত করা সম্ভব হবে। আমরা জানি, দেশকে রাতারাতি দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত দৃষ্টান্ত রেখে যেতে পারে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতিবিদরাও এ বিষয়ে জোর দিয়ে আসছেন। তাদের মতে, দুর্নীতি নিরসন ছাড়া দেশের অনেক সম্ভাবনা অকার্যকর রয়ে যাবে। আর দুর্নীতি দূরীকরণে দুর্নীতিবাজদের দৃশ্যমান শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। সেবাখাতে ভোগান্তির অবসান হওয়া দরকার।