দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের বিরল জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ সুরক্ষায় সরকারের গৃহিত বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র। দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বিরল জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারসহ দ্বীপটিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর (সংশোধিত ২০১০) ক্ষমতাবলে দ্বীপে বেশ কিছু কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। নিষিদ্ধ কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত ছেড়াদিয়া দ্বীপ ভ্রমণ, স্পিডবোট, ট্রলার বা অন্য কোনো জলযানের যাতায়াত ও নোঙর না করা, দ্বীপের চতুর্দিকে নৌ ভ্রমণ বন্ধ, সামুদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার স্থানে চলাফেরাসহ রাতের বেলায় সৈকতে আতশবাজি, গান বাজনা, বারবিকিউ পার্টি বন্ধ এবং প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, কেয়াফল ও বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী কেনাবেচা বন্ধ রাখা। সেন্টমার্টিনের সাধারণ বাসিন্দাদের অনেকে দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় সরকারের গৃহীত এসব সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু দ্বীপ রক্ষায় সরকারের এসব সিদ্ধান্ত শুরু থেকেই অমান্য করে আসছিল দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেল ও বিভিন্ন নৌযান সার্ভিস পরিচালনাকারী প্রভাবশালী একটি চক্র।
জানা গেছে, উল্লিখিত সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর বিরোধিতা করে গতকাল রোববার সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত দ্বীপে ধর্মঘট পালন করেছে একটি চক্র। এসময় তারা দ্বীপে পর্যটকবাহী নৌযান ভিড়তে বাধা দেয়। এছাড়া সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ও দোকানপাট সহ সকল প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখে। তারা এক সমাবেশে ছেড়াদিয়া ভ্রমণ বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিলসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানান। এ সমাবেশে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন নুর আহমদসহ পরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ জানান, ‘ছেঁড়াদ্বীপে পর্যটক নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করেছে দ্বীপবাসী। এখানে দ্বীপের বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ অংশ নিয়েছেন।’ তবে কর্মসূচিতে অংশ নেয়া সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে বা টেকনাফ থেকে ছেড়াদিয়া দ্বীপে যাতায়াতে কোনো স্পিডবোট, ট্রলার, কান্ট্রিবোট বা যেকোনো ধরনের নৌযানের অনুমতি নেই। যারা সেখানে পর্যটকদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন তারা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ করছেন। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক সেন্ট মার্টিনস কোস্ট গার্ডের এক কর্মকর্তা জানান, ছেড়াদিয়া দ্বীপে যাতায়াত বন্ধসহ, সেন্ট মার্টিনের বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে একটি পক্ষ ঘোর বিরোধিতা করছে। আজকেও তারা সভা, সমাবেশ ও ধর্মঘট পালন করেছে। এটা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক কর্মসূচি। তবে ছেড়াদিয়া দ্বীপে ভ্রমণ নিষিদ্ধসহ পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা বাস্তবায়নে এখনো কঠোর অবস্থান নেয়া হয়নি। আমরা নৌযান মালিক, স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের বুঝিয়ে সেখানে যেতে অনীহা তৈরির চেষ্টা করছি। কিন্তু অনেকেই সিদ্ধান্ত অমান্য করে চলছেন।
আইনের বাস্তবায়ন না থাকায় এ ধরনের ধর্মঘট পালন হচ্ছে উল্লেখ করে কঙবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘সবার উচিত আগে দ্বীপকে রক্ষা করা। সরকাররের নির্দেশনা স্থানীয় প্রশাসন সেটি বাস্তবায়ন করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষ অধিকার আদায়ের জন্য ধর্মঘট ডাকতে পারে, তাই বলে দ্বীপকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। যদি দ্বীপ না বাঁচে সেখানকার মানুষ যাবে কোথায়।’
এদিকে সেন্ট মার্টিনসের সাধারণ বাসিন্দাসহ সচেতন মহলের দাবি, দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা করে আমরা দ্বীপটিকে বাঁচিয়ে রেখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বসবাসযোগ্য দ্বীপ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। দ্বীপের পরিবেশ প্রতিবেশ বিপন্ন করে যারা শুধু বিপুল অর্থ আয়ের নেশায় সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছে তাদের সংখ্যা কম হলেও তারা সরকারের সিদ্ধান্তকে জনগণের কাছে ভুলভবে পৌঁছাচ্ছে। তারা মূলত দ্বীপটাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
দ্বীপের বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপকে ব্যবহার করে অনুমতি ছাড়া সার্ভিস বোট, স্পিডবোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌযানসহ নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র।
এদিকে সচেতনমহল বলছে, যারা দ্বীপের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানাচ্ছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে তারাই দ্বীপের স্বার্থবিরোধী কাজ করছে। আমরা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই এবং দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি।