জাতীয় কবি নজরুলের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধের উপস্থাপনা। ‘অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির, ভয়ে কাপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর।’– কোন ধরনের অন্যায়–অবিচার–বৈষম্যের কাছে মাথা নত না করার অবিস্মরণীয় স্মারক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশ মাতৃকার প্রতি ইঞ্চি ভূমির সুরক্ষায় নিরলস ব্রতে সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর। আকাশ–জল–স্থল নিষ্কন্টক এবং নিরাপদ রাখার গভীর সংকল্পে তারা ঋদ্ধ। আধুনিক প্রশিক্ষণে সদাজাগ্রত সেনাবাহিনী তথ্যপ্রযুক্তিসহ সকলক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। শুধু দেশকে শত্রুমুক্ত নয়; অভ্যন্তরীণ যেকোন আর্থ–সামাজিক–রাজনৈতিক সংকটে তাদের বিচরণ অনবদ্য। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনে দেশকে শত্রুমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ বিজয় অর্জনে অকুতোভয় সৈনিকের পরিচয়ে সেনবাহিনী বিশ্বনন্দিত। সকলস্তরে ঐকমত্যতার অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপনে সেনাবাহিনীর নান্দনিক সৌরভ উম্মোচিত। বাংলাদেশের সেনা–নৌ–বিমান বাহিনীর সকল সদস্যের যোগ্যতা–দক্ষতা ও দেশপ্রেম প্রকৃতই পরীক্ষিত। স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের অবিচল প্রতীক হিসেবে তারা সর্বত্রই সমাদৃত।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজা–মহারাজাদের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বাংলার সামরিক ইতিহাসের মূল। সেই সময়কালে সেনাবাহিনী গঠিত হত পদাতিক, অশ্বারোহী, যুদ্ধ হাতি এবং যুদ্ধজাহাজ নিয়ে। বাংলায় মুসলমানদের আগমন এবং সালতানাত এর প্রতিষ্ঠা বাংলার সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছিল। মুঘল শাসনামলে বাংলায় কামান ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচলন হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বাংলা ছিল দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে ব্রিটিশদের শক্তির সৌরভ। ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী, নবাব সিরাজ–উদ–দৌলার নেতৃত্বাধীন ৫০ হাজার সৈন্যের বাংলার সেনাবাহিনীকে পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত করে। পরবর্তীতে একই ব্রিটিশ বাহিনী ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাসিমের নেতৃত্বাধীন বাংলার বাহিনীকে পরাজিত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ‘ইস্টার্ন কমান্ড পাইওনিয়ার কোর’ নামক একটি সহায়ক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে যারা ছিল কিছুটা প্রকৌশলী এবং কিছুটা পদাতিক। বাহিনীটির বেশির ভাগ সৈন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা থেকে। এই বাহিনী মূলত রাস্তাঘাট ও বিমানঘাঁটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে মূল বাহিনীকে সাহায্য করত। প্রয়োজনে তারা পদাতিক বাহিনী হিসেবেও যুদ্ধ করত। এটিকে বিভিন্ন কোম্পানিতে সংঘটিত করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নানা রেজিমেন্টের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন গনি ছিলেন একজন কোম্পানি কমান্ডার এবং তিনি বার্মা ফ্রন্টে তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পূর্ব বাংলার যুদ্ধফেরত পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যদের নিয়ে একটি পদাতিক রেজিমেন্ট তৈরির ধারণা দেন এবং কেন্দ্রীয় কমান্ডের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুইটি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যার ফ্রাংক মেজারভি’র অনুমতি সাপেক্ষে ক্যাপ্টেন গনি পূর্ববাংলার সৈন্যদের নিয়ে বাঙালি পল্টন গঠন করেন। যা ছিল পরবর্তীতে গঠিত পদাতিক রেজিমেন্টের মূল ভিত্তি।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ভঙ্গুর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক–সামরিক–আঞ্চলিক বৈষম্যের চরিত্র ধারণকারী শাসকগোষ্ঠীর নব্য আন্তঃ–ঔপনিবেশিক যাঁতাকলে বাঙালি জাতিকে চরম নিষ্পেষণে নিপতিত করেছিল। পাকিস্তানের শাসন–শোষণ–অত্যাচার–নির্যাতন–বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘসময় ধরে বাঙালির আন্দোলন–সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। ২৫মার্চ রাতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মধ্য দিয়ে বেসামরিক বাঙালি জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। তারা হাজার হাজার সামরিক–বেসামরিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৬ মার্চ দিবসপ্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী স্ফুলিঙ্গে রূপান্তর ঘটে। ২৭ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের এবং পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মার্চ মাসেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সৈন্যরাও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক জনগণ মিলে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। ১৭ এপ্রিল গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কর্নেল (অব🙂 মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব অর্পণ করে।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক সদস্যদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী চলা স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখায় এবং ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তা ও সৈনিকদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭২–৭৩ সালের মধ্যেই সেনাবাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ার্স, সিগন্যাল, সার্ভিস, অর্ডিন্যান্স, মিলিটারি পুলিশ, অশ্ব গবাদি পশুপালন–খামার ও মেডিকেল কোর গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সেনানিবাস এ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম শর্ট কোর্সের পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি। ১৯৭৫ সালে গঠিত হয় প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর)। পরবর্তীকালে বিভিন্ন অভ্যুত্থান–ঘাত–প্রতিঘাতের দোলাচলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমান অবস্থানে উপনীত হয়েছে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি অপরিহার্য বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ সূচিত হওয়ার পর থেকেই এক অসাধারণ অধ্যায় রচনা করেছে। দেশের সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের অন্তর্ভুক্তি এবং কার্যকলাপ দেশের ভাবমূর্তিকে শান্তি মিশনের শীর্ষ অবস্থানে উন্নীত করেছে। ৬ মার্চ ২০২৫ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৩০ জন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা অনবদ্য হওয়ার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী সদস্যরা মিশন এলাকায় বিবাদমান দলসমূহকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় কর্মযজ্ঞ পালনসহ কঙ্গো, মালি, সুদান, সাউথ সুদান, সাহারা, লেবানন, হাইতি, পূর্ব তিমুরে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। প্রায় তিন যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সকল প্রান্তের দুর্গত–নিপীড়িত–নিরীহ মানুষের সেবায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের মানবিক হস্ত সর্বদা প্রসারিত।
১৯৯৩–৯৪ সালে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রুয়ান্ড, সোমালিয়া ও বসনিয়া– এ তিনটি শান্তি মিশনে নিজেদের সক্ষমতা–দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। ঐ সময় জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট দেশসমুহের কর্মকর্তাদের হতবাক করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষতা ও সামরিক জ্ঞানে উক্ত দেশসমূহে মিশনে দায়িত্ব পালনরত বেলজিয়ান, আমেরিকান ও ফ্রান্স সেনাবাহিনীকে ছাপিয়ে যায়। মূলত তখন থেকেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা বিদেশের মাটিতে শত্রুদের সামনে মাথা নত না করে, কঠিন বিপদ–সংকটময় মুহূর্তে জীবনঝুঁকির মধ্যেও জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করে যাচ্ছেন। আইভরি কোস্টের গোলযোগপূর্ণ অবস্থাকালীন সময়ে লাইবেরিয়ায় নিয়োজিত বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টগুলো প্রত্যক্ষভাবে শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবিলাসহ লাইবেরিয়ার সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল সহায়তায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক কর্মকান্ড স্থানীয় জনগণ ও সর্বমহলে উচ্চকিত।
স্মরণযোগ্য বিষয় হচ্ছে এই, জুলাই ২৪ ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। অত্যন্ত জটিল এই সংকটকালে জনগণ ও দেশের প্রতি সেনাবাহিনীর দায়বদ্ধতা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দৃঢ়চেতা মনোভাবে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রবল বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অসামান্য নিরপেক্ষতা ও দেশেপ্রেমের পরিচয় দিতে সম্পূর্ণ সফল। দেশকে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ থেকে বিরত রেখে শান্তিশৃঙ্খলা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা সুরক্ষায় অসীম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সমগ্র দেশবাসীর হৃদয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা–ভালোবাসা ও সমর্থন অকাট্য যুক্তিতে নির্ভার। কোন অবস্থাতেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য জনগণের আস্থাকে শিথিল করতে পারবে না। দেশী–বিদেশী নানামুখী ষড়যন্ত্র–গুজবসন্ত্রাস সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন অপচেষ্টাই সার্থক হতে পারে না। লাল–সবুজের পতাকার স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশের অকৃত্রিম প্রতীক দেশপ্রেমে ঋদ্ধ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরব–সৌরভ অপরাজিত থাকুক– মহান স্রষ্টার দরবারে এটুকুই প্রার্থনা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী।