রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান ওয়াকার–উজ–জামান আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে স্বাগত জানিয়েছে সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। তাঁরা বলেছেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। সেনাপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্পন্ন করে ১৮ মাস বা দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে যে কোনো পরিস্থিতিতে পূর্ণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইতোমধ্যে তাঁর সরকার সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে–এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য প্রধান উপদেষ্টা বা অন্য কোনো উপদেষ্টার মুখ থেকে আসেনি। ঠিক এরকম অবস্থায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান তাঁর নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না বলেও জানিয়েছেন তাঁর সাক্ষাৎকারে। তিনি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়েও কথা বলেন। সেক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীকে রাষ্ট্রপতির অধীনে নেওয়া যেতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সেনাপ্রধান ওয়াকার–উজ–জামান বলেন, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার একটি রূপরেখাও দিয়েছেন। সেনাপ্রধান বলেন, ‘যা–ই ঘটুক না কেন, আমি তাঁর (মুহাম্মদ ইউনূস) পাশে থাকব। যাতে তিনি তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন।’
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের অগ্রদূত ড. ইউনূস বিচার বিভাগ, পুলিশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক সপ্তাহ আগে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়া জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান বলেন, সংস্কারের পর গণতন্ত্রে উত্তরণ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে হওয়া উচিত। তবে তিনি একই সঙ্গে এ বিষয়ে ধৈর্য ধরার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তবে আমি বলব ওই সময়সীমার মধ্যে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত।’
সেনাপ্রধান আঠারো মাসের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন সে বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাঁরা মনে করেন নির্বাচন যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই হওয়া উচিত। নির্বাচন যত দ্রুত হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মাত্র দেড় মাস সময় হলো। অনেকগুলো সংস্কার প্রয়োজন নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য। আরেকটা কথা হলো যে, রাষ্ট্রে সংস্কার অনেকগুলো, সেগুলো একটা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা করতে পারবে। কিন্তু অরাজনৈতিক এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হলো–একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম যে সংস্কারটুকু দরকার–জনপ্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো হয়ে আছে, এই জায়গাতে হাত দিতে যেটুকু সময় লাগে সেটুকু সময় নেওয়াই উচিত। তাহলে জাতি বুঝতে পারবে কোন সময় গ্রহণযোগ্য। এখানে মাস–দিন–ঘণ্টার চেয়ে পরিস্থিতিটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে যা’ই বলুন না কেন, নির্বাচন নিয়ে এ দেশের মানুষের মনে যে প্রশ্ন বিরাজ করছিল, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু খোলাসা হয়ে গেছে। সেনাপ্রধান সময়মতো নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলেছেন, আবার একই সঙ্গে তিনি প্রয়োজনীয় সংস্কারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সহায়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। আমরা মনে করি, মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা সেনাপ্রধানের বক্তব্যে প্রতিভাত হয়েছে। এই বক্তব্যকে সাধারণ মানুষ ইতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করবেন–সেই প্রত্যাশা করছি।