২০২১ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী নানা আয়োজনে পরিপূর্ণ একটা বছর। তারিখটা ছিল ৮ই মার্চ, ২০২১। সারা বিশ্বে পালিত হয় এমন একটা দিন, ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। দেশের প্রথম টেলিভিশন সংবাদ পাঠিকা হিসেবে রূপান্তরিত নারী তাসনুভা আনান শিশির। তাসনুভা’এখন এক মাইল ফলক। পুরো কমিউনিটির জন্য এক বিরাট অর্জন। কিভাবে যেন খবরটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম টিভি পর্দার দিকে। কেন যেন চোখ সরাতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাসনুভা আমার কেউ হয় নয়, কিন্তু তবুও ওর এ্যাচিভমেন্টে চোখে জল চলে আসছিল বারবার। ভাবছিলাম ওর মা’য়ের কথা ,ভাবছিলাম আমাদের সমাজের কথা। একটা সন্তানের জন্য সহস্র মা’কে লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়, কটূকথা শুনতে হয় ঘরে বাইরে, বুকে বন্ধ্যাত্বের হাহাকার নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় এই পৃথিবীতে। অথচ তাসনুভার মায়ের মত আরো হাজারও মায়ের কথা যদি চিন্তা করি, যাদের সন্তানকে সামাজিক পারিবারিক চাপে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিতে হয়েছে! যে কোন সন্তানই তো তার নাড়ি ছেঁড়া ধন । মা’কে তো তার কান্না তার বুকের গভীরেই লুকিয়ে রাখতে হয়েছে, প্রকাশ্যে বেচারী কাঁদতেও পারেনি । এক সাক্ষাতকারে তাসনুভার প্রশ্ন, ‘তৃতীয় লিঙ্গ যদি আমাদের বলা হয় তাহলে বলতে হবে কে প্রথম কে দ্বিতীয়’? সত্যিই তো! যদিও পুরুষ শাসিত সমাজে এটাই অলিখিত সত্য যে প্রথম পুরুষ!
যাই হোক ছেলে বা মেয়ের মত তৃতীয় লিঙ্গও তো কারো না কারো সন্তান হোক সে হিজড়া বা রূপান্তরিত কেউ। তাহলে ‘হিজড়া’ নামটা গালি হিসেবে ব্যবহৃত হবে কেনো? ‘ছেলে’ কিংবা ‘মেয়ে’ কোনটাই তো গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। আসলে ‘হিজড়া’ নামটাই ওদের ছেলে কিংবা মেয়ে অর্থাৎ আমাদের সন্তানের পদমর্যাদা থেকে হাজার ক্রোশ দূরে ছিটকে ফেলে দিয়েছে। ‘হিজড়া’ না হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের নাম ছেলে-মেয়ের সাথে মিলিয়ে দুই অক্ষরের একটা নাম হতে পারতো, যা হয়তো তাকে ছেলেমেয়ের পাশাপাশি স্থান করে নিতে সহায়তা করতো।
‘হিজড়া’ তো রক্তমাংসে গড়া মানুষ , কোন মা’য়ের ঔরষজাত সন্তান। ঈশ্বরেরই সৃষ্টি, তাহলে কি ক্ষতি হবে সমাজের ওরা যদি মা-বাবা পরিবারে স্বজনের ছায়ায় অন্যান্য ভাইবোনের মত বেড়ে ওঠে, পরিবারের সদস্যদের আনন্দে আনন্দিত হয়, দু:খে দু:খী হয়, লেখাপড়া, গানবাজনা, খেলাধুলা ইত্যাদি পছন্দমত জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মা-বাবাকে গর্বিত করে! তাহলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে সমাজের? আমরা কমবেশী সবাই আমাদের ছোটবেলা মিস্ করি, বারবার স্মৃতিতে ফিরে যেতে চাই ছোটবেলা। তাসনুভা এক সাক্ষাতকারে বলেছে আমি কখনো ছোটবেলা ফিরে পেতে চাই না, ‘আমার কোন ভালো স্মৃতি নেই ছোটবেলার ‘কথাটা শুনলেই বোঝা যায় কতটা ভয়ঙ্কর হয় এদের শৈশব। সারাসময় এদের বুলিংয়ের স্বীকার হতে হয় । আমাদের বাঙালিরা সবসময় ‘কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দিতে ওস্তাদ। আমার ধারণা বোধহয় দুর্বল জায়গায় মলম না লাগিয়ে আঘাত করল সে সবল হয়ে উঠবে!
কত সন্তানের তো জন্ম হয় কত রকমের শারীরিক ত্রুটি নিয়ে, সারাজীবন বাবা মা’ বুকে নিয়ে রাখে সেই সন্তানকে, কই তাদের তো বাবা-মা পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হয় না! বরং ত্রুটিযুক্ত সন্তানের প্রতি মায়ের মমত্ব আরো একটু বেশীই থাকে। এটাও তো একধরনের শারীরিক ত্রুটি। শুধুমাত্র একটা অরগানের তারতম্যের কারণে কেন তাদের পরিবার থেকে, সমাজ থেকে ছিটকে পড়তে হবে? কেনই বা তাদের গড়ে তুলতে হবে তাদের নিজস্ব ডেরা?
ওদের সমাজ আলাদা কারণ ওরা পরিবার তথা আমাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত। ওরা অল্পে রেগে যায়, কারণ ওরা বঞ্চিত। ওরা গালিগালাজ করে কারণ আমরা ওদের দেখে মুখ ফিরিয়ে নেই। ওরা চাঁদাবাজি করে, বিরক্ত করে কারণ আমাদের পাশে থেকে শিক্ষার বা কাজ করার ওদের কোন সুযোগ নেই।
আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়ে’র মধ্যে বৈষম্য থাকলেও মানসিকতার এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে অস্বীকার করা যাবে না। সামাজিক পারিবারিক হাজারো বাধা বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের মেয়েরা তার আপন মহিমায়, কর্মযোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে। অধিষ্ঠিত হচ্ছে নানা সম্মানের আসনে। সংসার গাড়ির স্টিয়ারিং থেকে হাত না সরিয়েও ইট ভাঙা থেকে শুরু করে প্লেন চালানো এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর বিচরণ নেই ।হাট,মাঠ, ঘাট,শিক্ষা, সংস্কৃতি, অফিস, আদালত, মঞ্চ, আকাশ, পাতাল সব জায়গায় নারীর অবাধ বিচরণ ।আর পরিবারের পাশাপাশি বাইরের কাজের টেনশন মেয়েরা সহজেই নিতে পারে, বহুমুখী টেনশন দূর করার জন্য মেয়েদের কোন ধোঁয়া কিংবা পানীয়েরও প্রয়োজন হয় না। যারা এখন গৃহে বন্দী তারাও বের হয়ে আসবে একদিন আর দেখবে /দেখাবে আলোর মুখ , সেদিন কিন্তু খুব একটা বেশি দূরে নয় । ঠিক তেমনি
তাসনুভা’ প্রমাণ করেছে উপযুক্ত পরিবেশ শিক্ষা পেলে উন্নতির চরম শেখরে যে কোনকেউ পৌঁছাতে পারে । তাসনুভা কিন্তু তার সাক্ষাতকারে বারবার শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। বারবার বলেছে,‘আমি বুঝেছিলাম আমাকে অনেক লেখাপড়া করতে হবে।’ মেয়েরা যেমন বাধা বিপত্তি তুচ্ছ করে আজ এগিয়ে চলেছে , তাসনুভার প্রদর্শিত পথেও আশাকরি আমাদের এই বঞ্চিত সন্তানেরাও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে। তাসনুভাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে, যখন পাশে তার পরিবার ছিলনা। কিন্তু পরিবার পাশে থাকলে এদের যুদ্ধ আরোও শক্তিশালী হবে। একদিন দুদিন আঙুল তুলবে, পরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব।
সন্তান ঈশ্বর প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপহার। আমরা যেন তার অযত্ন না করি। সব সন্তানকেই সমমমতায় মানুষ করি । কারো জন্মগত অধিকার হরণ না করি। কেউ যেন আঙুল তুলে না দেখাই ‘হিজড়া’ কারণ সে ও তো আপনার কিংবা আমার মত কারো সন্তান। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটু উদার করতে পারলে আমাদের আর কোন সন্তান বঞ্চিত, অবহেলিত, নিগৃহীত হবেনা। হবে না বৈষম্যের শিকার। পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধবের অবহেলা আর নিপীড়নের শিকার হয়ে হিজড়াদের ডেরায় নিক্ষেপিত হবেনা আমাদের এই সন্তানেরা।
আমরা হিজড়া সমপ্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা বলি। রাষ্ট্রের আগে এ দায়িত্ব পরিবারের । পরিবারই পারে তাকে নিজের কাছে রেখে সমান ভালোবাসা দিয়ে তাকে স্বাভাবিক জীবন দিতে। স্পেশাল চাইল্ডের প্রতি যেমন পরিবারের মমত্ব একটু বেশী থাকে, এদের প্রতি নয় কেনো? জন্মের ওপর তো এদের হাত নেই? বিধাতাই এভাবে পাঠিয়েছে ওদের , আমরা খাটো করে দেখবো কেনো? আশপাশে স্কুলে কলেজে তুচ্ছতাচ্ছিল্য এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হলে পরিবারের সাপোর্ট খুব বেশী প্রয়োজন। ট্রান্সজেন্ডার হোক বা তৃতীয় লিঙ্গ হোক সবার একটা স্বাভাবিক জীবন প্রাপ্য। স্বাভাবিক জীবন পেলে এরাও সমাজ তথা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের দেশের মেয়েরা যেমন হাজারো বাধা প্রতিবন্ধকতা পেছনে ঠেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে , ঠিক তেমনি স্বাভাবিক পরিবেশে লালিতপালিত হলে এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরও একই ভাবে এগিয়ে যাবে শিক্ষায় সংস্কৃতিতে আমার বিশ্বাস। কবি কাজী নজরুলের পংক্তিকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায় : ‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে ওদের জয়’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার।