কালুরঘাট সেতুর জন্য প্রায় তিন যুগ ধরে অপেক্ষা চলছে বোয়ালখালীবাসীর। বছরের পর বছর ধরে এই সেতুর জন্য শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রাম নয়, পুরো চট্টগ্রামের মানুষ দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু নানা কারণে সেতুটি হয়নি। প্রকল্পটি এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ না দেখায় ওরা হতাশ, ক্ষুব্ধ।
কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত কালুরঘাট সেতুর বয়স প্রায় একশ বছর হতে চলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সেনা চলাচলের জন্য একটি সেতুর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানির ব্রিজ কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স–হাওড়া নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেতুটি নির্মাণ করে। শুধুমাত্র ট্রেন চলাচলের জন্য ৬৩৮ দশমিক ৫ মিটার দীর্ঘ সেতুটি কর্ণফুলী নদীতে ছয়টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টিল পিলার, দুটি এবটমেন্ট ও ১৯টি স্প্যান দিয়ে নির্মাণ করা হয়।
১৯৩০ সালের ৪ জুন সেতুটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। রেলসেতু হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্যদের ব্যবহৃত মোটরযান ও যুদ্ধযান চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৫৮ সালে এসে সেতুটিতে সব ধরনের যান চলাচল উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
দীর্ঘদিনের ব্যবহারে সেতুটি জরাজীর্ণ হয়ে যায়। জোড়াতালি দিয়ে এটিকে টিকিয়ে রাখা হয়। ২০০১ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। তবুও একাধিক বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম চালানোর মাধ্যমে সেতুটিকে চালু রাখা হয়। বোয়ালখালী ও পটিয়াসহ বিস্তৃত এলাকার লাখো মানুষের বিকল্প না থাকায় বছরের পর বছর ঝুঁকি নিয়ে কালুরঘাট সেতুর উপর দিয়ে রেল ও যানবাহন চলাচল করছে। সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারে ট্রেন নিতে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রমের জন্য গতকাল থেকে বন্ধ হয়েছে কালুরঘাট সেতু। চালু করা হয় ফেরি সার্ভিস। কিন্তু চালুর প্রথম দিনই দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের।
কালুরঘাটে বর্তমান সেতুটি ভেঙে নতুন সেতুর জন্য প্রথম দাবি ওঠে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল প্রচারণা চালাতে গিয়ে কালুরঘাট সেতু পুনঃনির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং আশ্বস্ত করেন। এরপর থেকে বোয়ালখালী আসনের প্রতিটি নির্বাচন এবং উপনির্বাচনে কালুরঘাট সেতু মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। প্রতিবারই প্রতিশ্রতি দেওয়া হয়, আশ্বস্ত করা হয়; কিন্তু সেতু হয় না।
দীর্ঘদিনের টানাপড়েন শেষে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কালুরঘাটে রেল–কাম সড়ক সেতু নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটি যাচাই–বাছাই শেষে কয়েক দফা পুনর্গঠন করা হয়। উপস্থাপনগত ত্রুটির কারণে প্রকল্পটি একনেক থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। পরে এই সেতুর একটি চূড়ান্ত ডিজাইন দাঁড় করানো হয়। ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেল প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে কালুরঘাটে অবস্থিত পুরনো রেল সেতুর স্থলে নতুন রেলওয়ে কাম রোড সেতু নির্মাণের নকশা প্রণয়ন করা হয়। এই ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত দ্য ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো–অপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) সাথে রেলওয়ের চুক্তি হয়। শূন্য দশমিক ৭২ কিলোমিটার লম্বা সেতুটির উপর দুটি রেলসড়ক দিয়ে ডিজাইন করা হয়।
পরে কোরিয়ার অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের আপত্তির কারণে একটি রেল সড়ক অন্তর্ভুক্ত করে নতুন ডিজাইন তৈরি করা হয়। প্রস্তাবিত নকশায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেতুর উচ্চতা ধরা হয় ৭ দশমিক ৬২ মিটার বা প্রায় ২৫ ফুট। কিন্তু এই উচ্চতার ব্যাপারে আপত্তি জানায় বিআইডব্লিউটিএ। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেতুর যে উচ্চতার কথা বলা হয়েছে তাতে নেভিগেশন চ্যানেল হুমকির মুখে পড়বে। সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার বা ৪০ ফুট করার শর্ত দেয় বিআইডব্লিউটিএ।
এভাবে একটির পর একটি প্রতিবন্ধকতা। পার হয়েছে বছরের পর বছর। দেশে অনেক কিছু হয়েছে, কিন্তু কালুরঘাট সেতু এখনো হয়নি। সেতুটির জন্য অপেক্ষা করছে হতাশাগ্রস্ত বোয়ালখালী। তারা আশায় আছে।