আনুমানিক দুদিন বয়সী নবজাতক শিশু পড়ে ছিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর বাবরা খালের পাড়ে। কান্নার শব্দ শুনে শিশুটিকে উদ্ধার করেন এক নারী। চারিদিকে এ নিয়ে হইচই পড়ে গেলে থানা পুলিশসহ সবাই এগিয়ে আসে। যারা শিশুটিকে অবহেলায় ফেলে গিয়েছিল, সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা করেও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে যেহেতু শিশুটির জন্ম হয়েছিল, তাই উপজেলা প্রশাসন শিশুটির নাম রাখে, ‘বিজয়।’ সেই বিজয়কে পেতেই তৈরি হয়েছিল অনেকের প্রতীক্ষা। তার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব কারা পেতে যাচ্ছেন–অবশেষে তা আদালতের মাধ্যমে ঠিক হয়েছে।
আদালতে জমা পড়া দুটি আবেদনের উপর গতকাল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে বেশ কয়েকটি শর্তে বোয়ালখালীরই ব্যবসায়ী মো. রুবেল ও ফারজানা আকতার বেবী দম্পত্তির জিম্মায় বিজয়কে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে নিঃসন্তান এ দম্পত্তিই খালের পাড়ে পড়ে থাকা বিজয়ের প্রতিপালনের দায়িত্ব পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–১ এর বিচারক মোস্তাক হোসেন শিশু আইন, ২০১৩ এর ৬৮ ধারা ও জাতিসংঘের শিশু ওয়েলফেয়ার বিধি অনুসরণ করেছেন। আদালতে আবেদনকারী অপরজন হলেন, জেলার মীরসরাইর বাসিন্দা। এ দম্পতিরও কোন সন্তান নেই। কিন্ত আর্থিকভাবে সচ্ছল। কিন্তু মো. রুবেল আর্থিকভাবে একটু বেশি সচ্ছল হওয়ায় আদালত তার আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন। নগরীর চট্টেশ্বরী রোডে জিমের সরঞ্জাম বিক্রির ব্যবসা রয়েছে মো. রুবেলের। বোয়ালখালীতে গ্রামের বাড়ি হলেও থাকেন নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায়।
আদালতের দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ওয়ারিশবিহীন নবজাতক বিজয়কে জিম্মায় পেতে হলে তার নামে ২০ লাখ টাকার এফডিয়ার দেখাতে হবে। আদালতের সেই শর্ত খুশিমনে মেনেও নিয়েছেন মো. রুবেল ও ফারজানা আকতার বেবী দম্পতি। আদালতের আদেশের পর এফডিয়ার সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতের কাছে জমাও দিয়েছেন বিজয়ের আদালত কতৃক ঠিক করে দেওয়া পিতা–মাতা।
আদালতে মো. রুবেল ও তার স্ত্রী ফারজানা আকতার বেবীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তাহমিনা আকতার চৌধুরী (রানি)। তার সাথে আরো ছিলেন আইনজীবী সেলিম উল্লাহ চৌধুরী, জাহেদুর রহমান, মফিজুর রহমান, মোজাম্মেল হোসেন ও আনিসুল ইসলাম। আইনজীবী তাহমিনা আকতার চৌধুরী (রানি) আজাদীকে বলেন, নবজাতক শিশুকে উদ্ধারের পর তাৎক্ষনিক তার নাম রাখা হয়েছিল বিজয়। এখন তার পিতা–মাতা হয়েছে। তারা আকিকা করে বিজয়ের নতুন নাম রাখবেন। নিঃসন্তান ছিলেন, এ জন্য মো. রুবেল ও তার স্ত্রী বর্তমানে অনেক খুশি। তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন।
তিনি বলেন, শুনানির সময় নবজাতক শিশু আদালতে উপস্থিত ছিলে। পরে তাকে চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অবস্থিত সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোট মনি নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খাল পাড় থেকে উদ্ধার পরবর্তী তাকে সেখানে রাখা হয়েছিল। অধিদপ্তরের দাপ্তরিক কার্যক্রম শেষে নবজাতক শিশু বিজয়কে আদালতের ঠিক করে দেওয়া পিতা–মাতার কাছে হস্তান্তর করা হবে।
শিশু বিজয়ের জিম্মা পেতে আদালতে করা আবেদনে মো. রুবেল ও তার স্ত্রী ফারজানা আকতার বেবীর আইনজীবী উল্লেখ করেন, এ দম্পতির ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। সন্তান হচ্ছিল না বলে তারা নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ এবং মেডিকেল পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত দেয় যে, সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আবেদনে বলা হয়, নবজাতক বিজয়কে জিম্মায় পেলে তাকে সন্তানের ন্যায় ভালোবাসা, আদর–যত্ন, সেবাসহ লালন–পালন, ভরণপোষণ, লেখাপড়া, চিকিৎসা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন মো. রুবেল ও তার স্ত্রী। এছাড়া সমস্ত স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি, টাকা পয়সা নিজ সন্তান হিসেবে তার নামে লিখে দিবেন।
চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–১ এর পিপি আলমগীর মোহাম্মদ ইউনুছ আজাদীকে বলেন, নিঃসন্তান দম্পতি পেলেন সন্তান আর ওয়ারিশবিহীন শিশু পেলেন পিতা–মাতা। এতে আমরা সবাই খুশি। আল্লাহ নবজাতক শিশুটিকে ভালো রাখুক সেই প্রত্যাশা আমাদের।
গত ২৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর বাবরা খালের এক পাড়ে গোসল করতে গিয়েছিলেন মুন্নি দাস নামের এক নারী। তখন তিনি খালের অপর পাড়ে একজন নবজাতক শিশু ছেলের কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। তাৎক্ষণিক তিনি ঐ পাড়ে সাতরে গিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে এলাকার লোকজন থানাকে বিষয়টি জানান। থানা পুলিশ শিশুটিকে বোয়ালখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে ভর্তি করেন। পরে তাকে রৌফাবাদের ছোট মনি নিবাস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।