চট্টগ্রামের আকাশটা সেদিন ছিল ভারী মেঘে ঢাকা। বাতাসে যেন এক অজানা অস্থিরতা– অপরিচিত কোনো বিপদের আগাম ইঙ্গিত। তারিখটা ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর, শুক্রবার। দুপুর পেরিয়ে জুমার আজান পড়তে আর কিছুক্ষণ বাকি। আমি তখন কিশোর। আমার বাড়ি শিকলবাহা থেকে গাড়িতে করে যাচ্ছি চন্দনাইশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চট্টগ্রাম– কক্সবাজার মহাসড়কের হাশিমপুর গাছবাড়িয়া এলাকায় হঠাৎ বিকট এক শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। সবার মতো আমিও দৌড়ে গেলাম রাস্তার পাশে। সামনে যে দৃশ্যটা দেখলাম, তা আজও চোখে ভাসে– রক্তে ভেসে গেছে রাস্তা, এক মাইক্রোবাস উল্টে পড়ে আছে, আশপাশের মানুষ হতভম্ব।
চারদিকে জটলা জমেছে, কেউ দেখছে, কেউ কেউ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলেন– তখনকার নতুন প্রযুক্তি, মোবাইল হাতে। কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না। আমি নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম– মানুষ কবে এত নির্দয় হয়ে গেল?
হঠাৎ দেখলাম, গাড়ির পাশে দুটি শিশু কাঁদছে বুকভাঙা কান্নায়। তাদের সেই কান্না যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছিল আমার পুরো সত্তাকে। পাশে পড়ে আছেন এক রক্তাক্ত মহিলা, নিস্তব্ধ, অচেতন। মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেলাম– এখানে সময়ই সবচেয়ে বড় শত্রু। ছুটে গিয়ে দুই শিশুকে বুকে তুলে নিলাম। তাদের নাম পরে জানতে পারি ইমা ও জয়। কাছের এক বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে তাদের রেখে এলাম বাবুলের মায়ের কাছে। তিনি মমতার হাতে শিশু দুটিকে আগলে রাখলেন।
এরপর শুরু হলো জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই– এক আহত প্রাণকে বাঁচানোর যুদ্ধ। কোথাও অ্যাম্বুলেন্স নেই, গাড়ি নেই, চারপাশে শুধু উদাসীন চোখ। হঠাৎ দেখি একটি সবজি বোঝাই রিকশাভ্যান। সেটিকেই বানিয়ে ফেললাম আমাদের অস্থায়ী অ্যাম্বুলেন্স। ভ্যানচালকের চোখে ভয়, কিন্তু আমার চোখে একটাই সংকল্প– এই মহিলাটিকে বাঁচাতেই হবে।
স্থানীয় হাসপাতালে পৌঁছে জানলাম– ডাক্তার জুমার নামাজে গেছেন। তখন বুঝলাম, জীবন–মৃত্যুর ব্যবধান কত সূক্ষ্ম হতে পারে! অবশেষে তাঁকে ডেকে আনা হলো। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তিনি বললেন, ‘দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিক্যালে নিন, নইলে আর সম্ভব নয়।’ কিন্তু শহরে পেঁৗঁছানোর আগেই নিভে গেল সেই জীবনের আলো।
পরে জানলাম, যিনি রক্তে ভেজা অবস্থায় নিথর হয়ে শুয়ে ছিলেন, তিনি আর কেউ নন– বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী, জাহানারা কাঞ্চন। মুহূর্তেই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। আমার কিশোর মনে তখন এক অজানা প্রশ্ন–কেন কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায়নি? কীভাবে এমন অসচেতনতা একটা প্রাণ কেড়ে নিতে পারে?
এক দিনের শোক, এক জাতির জাগরণ : সেই দিনের ঘটনাই শুধু ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবন বদলে দেয়নি– আমাকেও বদলে দিয়েছিল। আমি তখনই উপলব্ধি করেছিলাম, এই দেশে মানুষ মৃত্যুবরণ করছে কেবল অবহেলায়। সেদিন যে অমানবিক দৃশ্য আমি দেখেছিলাম, তা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চন সেই শোককে পরিণত করেছিলেন এক শক্তিতে। স্ত্রী হারানোর বেদনা তাঁকে বানিয়ে দিয়েছিল এক নতুন আন্দোলনের পুরোধা ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’।
আমি তখন থেকে তাঁর পাশে। কিশোর বয়সের সেই দৃশ্যই আমাকে আজও মানবতার পাঠ শেখায়।
নায়ক থেকে মানবতার প্রতীক : ইলিয়াস কাঞ্চন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৭৭ সালে বসুন্ধরা ছবির মাধ্যমে তাঁর অভিনয়ে পথচলা শুরু। অসংখ্য সিনেমায় তিনি দর্শকের হৃদয় জয় করেন। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও আজীবন সম্মাননা। কিন্তু আজ তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়– একজন মানবতার নায়ক। যে মানুষ প্রিয়তমাকে হারিয়ে অন্যের জীবন বাঁচানোর স্বপ্নে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি হয়ে উঠেছেন এক জাতির অনুপ্রেরণা।
নিরাপদ সড়ক চাই: এক মানুষের স্বপ্ন থেকে জাতীয় আন্দোলন : ইলিয়াস কাঞ্চনের হাতে জন্ম নেয়া ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’ আজ সারা বাংলাদেশের আন্দোলন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, মানুষ যদি সচেতন হয় এবং আইন যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ হয়, তাহলে প্রতিদিনের এই মৃত্যুমিছিল থামানো সম্ভব। সেই বিশ্বাসে তিনি ঘুরেছেন শহর থেকে গ্রামে, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাস্তায় থেকে টেলিভিশনের পর্দায়– প্রচার করেছেন নিরাপদ সড়কের বার্তা। তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের ফলেই সরকার ২০১৭ সালে ২২ অক্টোবরকে ঘোষণা করে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে। যে দিন একসময় ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন, আজ সেটিই পরিণত হয়েছে জাতীয় চেতনার প্রতীকে।
প্রতিবার এই দিনটি পালন করতে গিয়ে আমার মনে পড়ে সেই দুপুরের কথা– রক্তে ভেজা রাস্তা, আতঙ্কিত দুটি শিশু, আর ভ্যানের ওপর নিস্তব্ধ এক নারী। মনে হয়, সেই কান্নার প্রতিধ্বনিই আজ প্রতিফলিত হচ্ছে নিসচার স্লোগানে– ‘সড়ক দুর্ঘটনা নয়, এটি প্রতিরোধযোগ্য।’
প্রার্থনায় এক মানবিক নায়ক : সময় অনেক গড়িয়েছে, কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চনের লড়াই থামেনি। স্ত্রী হারানোর বেদনা তাঁকে বানিয়েছে মানুষের জীবনরক্ষার সৈনিক। তিনি হয়তো আজ অসুস্থ, কিন্তু তাঁর আন্দোলন আজ কোটি মানুষের চেতনায় অঙ্কুরিত।
আমি কৃতজ্ঞ– কারণ জীবনের শুরুতেই এমন এক ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরেছিলাম, যা আমাকে মানবতার প্রকৃত অর্থ শিখিয়েছে। সেদিন আমি বুঝেছিলাম, অন্যের জীবন বাঁচানোর কাজই মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
২২ অক্টোবর শুধু একটি তারিখ নয়– এটি এক জাতির বিবেকের প্রতিচ্ছবি। আমি এখনো বিশ্বাস করি– যেদিন আমরা সবাই নিজের ও অন্যের জীবনের দায়িত্ব নেব, সেদিনই পূর্ণ হবে ইলিয়াস কাঞ্চনের স্বপ্ন: একটি নিরাপদ সড়কের বাংলাদেশ।
লেখক: সংবাদকর্মী ও সাধারণ সম্পাদক, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি।