সেই পুরনো কানাগলিতে আবারও আমাদের রাজনীতি

কাজী রুনু বিলকিস | রবিবার , ৫ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

আবারও সেই পুরনো চেহারায় ফিরলো বাংলাদেশের রাজনীতি। ২৮ তারিখের ডেডলাইন, সংঘাত সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, হরতাল, অবরোধ, মৃত্যু নিয়ে আবারও সেই পুরনো কানাগলিতে ঢুকলো আমাদের রাজনীতি। পাঁচ বছর পর পর জাতীয় নির্বচনের আগে জাতি অনিবার্যভাবে এই রক্তাক্ত সংকটে পড়ে। কিছু অসহায় পরিবার কে বলি দিতে হয় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে। কিছু দুর্ভাগা সন্তান আরও দুর্ভোগে পড়ে। কিছু পরিবার নিঃস্ব হয়! এই যেন রুটিন ওয়ার্ক। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে আমরা দেখছি এই এপিসোড গুলো। দুর্ভাগ্য আমাদের, এতো এতো সংঘাতের পরও কোন রাজনৈতিক দল এই সংকট থেকে উত্তরনের পথ খুঁজেনি। বরং যার যার মতো করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চেষ্টা করেছে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাঁধে কথা না রাখার বোঝা। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের ৮দল, বি এন পির সাতদল ও বামপন্থী পাঁচ দলের মোট তিন জোটের একটা রূপরেখা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। ত্রিশ বছর কাটলো! সেই রূপরেখায় তিন জোটের ঐক্যমত্য হয়েছিলো জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, মিডিয়ার স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব কালাকানুন বাতিল করা। কিন্তু কোন দলই সেই পথে হাঁটেনি। ক্রমশ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছে। বি এন পি ক্ষমতায় ছিল। কি করেছে সেই ইতিহাস মানুষ ভুলেনি। বিরোধী দলকে নির্মূল করার চেষ্টা করেছে। এখন আওয়ামী লীগ ও একই কাজ করছে। লজ্জাজনক ব্যাপার হচ্ছে আমরা নিজেরা বসে সেই সমস্যার সমাধান না করে বিদেশি শক্তির কাছে যাচ্ছি সমাধানের পথ খুঁজে পেতে। ১৯৯৬সালে এমন সংকট সমাধানের জন্য এসেছিলেন কমনওয়েলতের দূত স্যার নিনিয়ান কাজ হয়নি। সহিংসতা হয়েছে। ২০০৬সালে ড্যান মজিনা ও ফেল করেছিলেন এখন পিটার হাস যে পাশ করবেন তারও বা নিশ্চয়তা কোথায়! আওয়ামী লীগের দাবীতাদের অনেক অর্জন আছে। তারা যুগান্তকারী অবকাঠামো তৈরি করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্‌্েরারেল, কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু টানেল করেছে, জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে, আধুনিক বিমান বন্দর করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানজনক ভাতার ব্যবস্থা করেছে, আশ্রয়ন প্রকল্প করেছে। সবই ঠিক আছে। আমাদের স্বাধীনতা ও এসেছে এই আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মানুষ তা জানে বুঝে। কিন্তু মানুষ যা দেখতে চায়নি সেটা ও দেখেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার তান্ডব ও দেখেছে। গ্রামে গন্‌েজ মোটরসাইকেলের ধূলো উড়িয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করা আওয়ামী লীগের কর্মীদের বেপরোয়া আচরণ মানুষ নিতে পারেনি। দখল বেদখলের খেলা মুরব্বিদের ব্যথিত করেছে।এমন নয় যে এ খেলা শুধু আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের কিংবা যুবলীগের। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে একই কাজ করে। সামনে ক্ষমতায় আসলে একই কাজ করবে বরং একটু বেশিই করবে বুভুক্ষু হিসেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ গোল্ড ফিসের স্মৃতি নিয়ে আবারও ভুলে যাবে। চার চারটি নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কেউ মানেনি। সংসদ কখনো রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়নি। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে কোন দল ভূমিকা রাখেনি। গণতন্ত্রের মৌলিক যে সমস্যাগুলো আমরা তা সমাধান ও করতে পারিনি।

যুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়েছে। আমাদের মতো দেশগুলোর অর্থনীতি বিপজ্জনক অবস্থায়। মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছেনা। সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত জনজীবনকে আরও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে। এই সংকটের সমাধান একমাত্র বিবাদ মান রাজনৈতিক দলগুলোরই হাতে। তারা চাইলে এই ধারাবাহিক সংকট সমাধানের একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। দুই পক্ষ তালগাছ ধরে বসে না থাকলেই হয়। এদেশ তো শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর নয়।এদেশ তো সাধারণ মানুষের ও। যাদের রক্তে ঘামে জিডিপির চাকা ঘুরছে। ইতিমধ্যে শ্রমিক বেল্ট উত্তপ্ত হয়েছে। সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর মিরপুরের পোশাক শ্রমিকেরা বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে নেমেছে বা নামানো হয়েছে। রাজনীতির আগুনে যুক্ত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক অন্তত বিগত আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তাই বলছে।

স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পার করে মুক্তিযুদ্ধের যে কমিটমেন্ট ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তাঁর দল ধরে রাখতে পেরেছে কি? অথবা সরে আসেনি? প্রশ্ন থেকে যায়। আর একদল না মানে বঙ্গবন্ধুর অবদান, না মানে মুক্তি যুদ্ধের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। শুধু মাত্র রেডিও ঘোষণায় মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসকে সীমিত করতে চায়। কোনটাই মঙ্গলজনক নয়। সবকিছু নিয়েই একটা ঐক্যমত্য হোক। সংলাপ হোক, সমঝোতা হোক। দেশের অবস্থা স্বস্তিদায়ক হোক। বারবার দলগুলো যেন তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করে।

ভুয়া ভোটার তালিকা, বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো, গ্রেনেড হামলার মতো জঘন্য পরিকল্পনা থেকে যেমন সরে আসা উচিত তেমনি রাতের অন্ধকারে ব্যালট বাক্স ভরা থেকে বের হয়ে জনগণের উপর আস্থাশীল হওয়াটাও জরুরি। বিদেশি শক্তি এই নির্বাচন নিয়ে ভীষণ সক্রিয়। তারা তাদের আধিপত্য বলয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চায়। তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য তারা বাংলাদেশ এবং বঙ্গোপসাগরকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ আমাদের জন্য সম্মানজনক নয়। আমাদের দেশের গনতন্ত্রের জন্য তাদের মায়াকান্না ঠিক তার বিপরীতে গাজায় শিশু হত্যা, নারী হত্যা, নিরপরাধ মানুষ হত্যার মতো অপরাধের অংশী হওয়া আমাদেরকে ভিন্ন বার্তা দেয়। সুতরাং আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। দীর্ঘ মেয়াদি একটা সমঝোতায় আসুক।একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। দেশের মানুষ উৎসবের মতো করে ভোট দিতে যাক। তাদের এই অধিকারটুকু তারা কখনও হারাতে চায়না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধজাতীয় রাজনীতি, সংসদ নির্বাচন ও চট্টগ্রামের ছাত্ররাজনীতির নায়করা