আজকালকার তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রত্যেকের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। তারা বইয়ের চেয়ে মোবাইল ফোনেই সময় কাটাচ্ছে বেশি। তারা কোনো কিছু জানতে চায়লে বই নয় গুগলকেই বেছে নেয়। যে তথ্য কেবল প্রয়োজন মেটায়, নিজেকে সমৃদ্ধ করে না। নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার একমাত্র উপায় বই, বই আর বই।
আমরা প্রায়শই বলে থাকি আজকালকার বাচ্চারা বইমুখী নয়। কথাটা কতটুকু সত্যি বলা মুশকিল। শিশু কিশোরদের বইমুখী করার জন্য লেখক প্রকাশকরা কতোই না চেষ্টায় থাকেন, সময়ে অসময়ে বইমেলা, প্রকাশনা উৎসব আরো কতো কী? কিন্তু শিশু কিশোররা কতোটুকুই বা উপকৃত হচ্ছে এতে, কিম্বা আমরা আদৌ কি তাদের বইমুখী করতে পারছি?
বইমুখী করার জন্য শুধু কি বই মেলা বা প্রকাশনা উৎসব। সম্প্রতি কিছু বইবিক্রয় কেন্দ্র ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আজকের প্রজন্মদের বইমুখী করার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শৈলী প্রকাশন, বাতিঘর, তারা বিভিন্ন সময়ে এ প্রজন্মকে বইমুখী করতে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
শৈলী প্রকাশন একমাত্র প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠান সারাবছরই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্যদিয়ে শিশু–কিশোরসহ তরুণদের বইমুখী করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাথে সাথে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে লেখকদের। শুধু একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশের যে প্রবণতা প্রকাশকদের মধ্যে দেখা য়ায় তার বাইরে এসে শৈলী সারা বছরই বই প্রকাশ করে যাচ্ছে এবং তা বিপননের ব্যবস্থা করছে। এতে একটি প্রকাশনা সংস্থাকে টিকিয়ে রাখাসহ লেখকদের লেখকসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন শৈলী প্রকাশনের কর্ণধার বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ও শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ। যিনি একা নন সবাইকে নিয়ে একসাথে চলতে পছন্দ করেন।
শোক দিবসকে স্মরণ করে শৈলী প্রথম বারের মতো আয়োজন করেছে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক নিয়ে ১৫ দিনব্যাপী ‘জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধু’, সাথে শৈলী প্রকাশনের বইমেলা। বইমেলা তথা বই বিপণনের ক্ষেত্রে শৈলী অগ্রিম গ্রাহক করেছেন শতাধিক পাঠককে যারা পাচ্ছেন দ্বিগুণ বই। চট্টগ্রামের সাহিত্য–সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বরাই ‘জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধু’র ১৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় বিভিন্ন ভূমিকা পালন করছেন। একটি প্রকাশনা সংস্থা শুধু বই প্রকাশ আর বিপননের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি জাতীয় ভূমিকাও পালন করতে পারে শৈলী প্রকাশন তা দেখিয়ে দিয়েছে। যে কাজটি করার কথা ছিলো কেনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয়ভাবে সে কাজটি করেছে শৈলী প্রকাশন ক্ষুদ্র পরিসরে বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এ দুঃসময়ে প্রবল বিষ্টি বাদল উপেক্ষা করে যেভাবে প্রতিদিন যে পরিমাণ পাঠক দর্শক উপস্থিত হচ্ছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।
সম্প্রতি আমাকে আরো একটি বিষয়টি খুব আশান্বিত করেছে জামালখানে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে ‘ফেইলড ক্যামেরা স্টোরেজ’ এর ব্যানারে আয়োজিত ৪র্থ বই মিনিময় মেলা। এবারের স্লোগান ছিল ‘বই নয়, জ্ঞানের বিনিময়’। সহযোগিতা করছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। সেদিন কাকতালীয়ভাবে আমার চোখে পড়ে একটি ব্যানার। কৌতুহলবশত একটু ঢু মেরে দেখলাম। বইমেলার মতোই শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের গ্রাউন্ডফ্লোরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন টেবিল। স্কুল পড়ুয়া কিশোর–কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের উৎসুক পাঠকদের ভিড়। এখানে কেনো বই বিক্রয় নয়, হচ্ছে বই বিনিময়। আপনার কাছে যদি কোনো পুরাতন বই পড়া হয়ে থাকে তা আপনি ক্যাটাগরি ভিত্তিক বই জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে অন্য বই নিতে পারেন। এতে কী হচ্ছে? এতে হচ্ছে, আপনি যে বই পড়েননি বা কেনা হয়নি, সে বইটি আপনি এখান থেকে বিনিময়ে পেয়ে যাচ্ছেন। যদি তাদের কালেকশনে থেকে থাকে। তবে একটি বিষয় আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে তা হচ্ছে এ বর্ষা বাদল দিনে বিষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রচুর ছেলে মেয়ে কেউ মা–বাবার হাত ধরে, কেউ বন্ধু বান্ধব দল বেঁধে আসছে বই হাতে, আবার বিনিময়ে তারা বই নিয়ে যাচ্ছে হাসি মুখে। তাদের চোখে মুখে যে বাঁধ ভাঙা খুশির জোয়ার। তারা যেনো ঈদের জামা কিনতে আসলো।
অরগানাইজাদের একজন জাবেদ মাহমুদের সাথে আলাপে জানা যায়, তারা ৪র্থ বারের মতো করছে এ আয়োজন। প্রথমবার ২১ শে করোনাকালে, ২য় ও ৩য় বার করেছে ২২ শে। এবার ২৩ শে এসে করছে ৪র্থবার।
বই বিনিময় উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপসচিব শাব্বির ইকবাল। এমন উৎসবের ধারণাকে আরো বেশি ছড়িয়ে দিতে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
উৎসবস্থল পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মুহাম্মদ মিজানুর রহমান। আরো পরিদর্শন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, রম্যসাহিত্যিক ও দৈনিক আজাদীর সম্পাদক জনাব এম এ মালেক। তিনি বলেন, জ্ঞানচর্চায় আমরা যে পিছিয়ে নেই, আমাদের তরুণেরাও যে সৃজনশীল চিন্তা করতে পারেন তারই এক স্বাক্ষর রাখলেন আয়োজকেরা। কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও অন্যান্য, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, কবিতা, ক্যারিয়ার ও বিজ্ঞান, সমগ্র, শিশুতোষ ও ম্যাগাজিন, একাডেমিক, আত্মজীবনী, ইতিহাস ও রাজনীতিসহ মোট এগারোটি স্টলে দিনব্যাপী এই বই বিনিময় উৎসবে প্রায় ১৪ হাজার বই বিনিময়ের কথা জানান আয়োজকেরা।
ফেইলড ক্যামেরা স্টোরেজ এর মূলত কাজ হচ্ছে নাটক সিনেমা বানানো। নাটক যে সমাজ পরিবতনের হাতিয়ার তা আরো একবার প্রমাণ করলো তারা। কেবল নাটক নয় ভিন্ন এরকম একটি উদ্যোগ নিয়ে। সৃজনশীল চিন্তায় তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাঠককে বইমুখী করতে এ ধরনের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। বই মানুষকে আলোকিত করে। নিজেকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক