একুশে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, শিশুরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, আর শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা তাদের স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসে। শিশুসাহিত্যিকরা অবিরাম পরিশ্রম করে রচনা করেন শিশুসাহিত্য, শিশুদের সম্পৃক্ত করেন সৃজনশীল সুন্দর জগতে। সৃষ্টি করেন সুন্দর মনের মানুষ। সৃজনশীলতা মানুষের মনের অসুন্দরকে বর্জন করে মানুষের ভেতরের কলুষতা ও হিংসা দূরীভূত করে অমানবিকতার ছায়া মুছে ফেলে। সৃষ্টি করে অনন্য সুন্দর মনের মানুষ। তিনি শিশু–কিশোরদেরকে লেখাপড়ার পাশাপাশি মানবিক মানুষ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। গতকাল শুক্রবার বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারি মিলনায়তনে কিডস কালচারাল ইনস্টিটিউটের ৩৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে শিশুউৎসব ও মিলন মেলার উদ্বোধক ও প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এম.এ মালেক বলেন, শিশুদের মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তাদের রয়েছে জানার স্পৃহা। এই জানার স্পৃহা জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। কেননা শিক্ষাই হলো মূল ভিত্তি। শিক্ষা অর্জিত না হলে আমরা কখনো পরিপূর্ণ মানুষ হবো না। আর শিক্ষা অর্জনের জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, শিক্ষার আলো হচ্ছে–সূর্যের কিরণের মতো। যা আড়াল করা যায় না। সূর্যের আলো আড়ালে রাখা যায় না। ঘন কালো মেঘও কেটে যায়। একজন মহৎ প্রাণ মানুষ সমাজকে আলোকিত করে, দেশকে আলোকিত করে। তিনি বলেন, মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী; এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে আমরা যে সময়টুকু পেয়ে থাকি তাতে মানুষের জন্য, সমাজের জন্য সর্বোপরি দেশের জন্য ভালো কিছু করে যেতে পারি তাহলে মানুষ আমাকে মনে রাখবে।
আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, শিশু–কিশোরদেরকে লেখাপাড়ার পাশাপাশি সাহিত্য–সংস্কৃতি ও মানবিকতা চর্চায় ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালাতে হবে। শিশুদের ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে না পারলে ভালো সমাজ তৈরি হবে না এবং সেটা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে মা–বাবা এবং শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে একুশে পদক প্রাপ্ত আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, অভিভাবকদের উচিত শিশুর মধ্যে একটি করে স্বপ্ন গেঁেথ দেওয়া। তাদের মনে স্বপ্ন গেঁেথ দিতে পারলেই সে জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেতে পারবে; তাদের বিবেক বোধ জাগ্রত হবে।
তিনি বলেন, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আদালত হলো তার বিবেক। আমরা যদি বিবেকে তাড়িত হই, তাহলে মানবিক হয়ে উঠতে পারবো। আমরা দুটি জিনিস দিয়ে তাড়িত হই–একটি মন আর একটি হলো বিবেক। মনকে সরিয়ে আমরা যদি বিবেক দিয়ে তাড়িত হই–তাহলে সেই আদালতের কাজটিই করতে পারবো।
জনাব এম এ মালেক বলেন, মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, মানুষের জন্য অসম্ভব বলেও কিছু নেই। আমি যেটা পারবো না সেটা আপনি পারবেন, আপনি যেটা পারবেন না সেটা অন্য কেউ পারবে। আর এভাবে সকলে মিলেই পৃথিবীকে সবার বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। নিজেকে উদাহরণ হিসেবে গড়ে তোলা খুবই কঠিন কাজ উল্লেখ করে জনাব এম এ মালেক বলেন, আমাদের চেষ্টা করতে হবে যেন নিজেদের উদাহরণ হিসেবে গড়ে তোলা যায় এবং সবার মধ্যে সেই লক্ষ্য–ই থাকা উচিত। তিনি বলেন, আমরা সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। এর জন্য সরকার, সমাজ, শিক্ষক, অভিভাবক সবার দায়িত্ব আছে। এই পৃথিবীতে মাত্র তিনজন মানুষ আছেন যারা তোমার থেকে কোনো কিছু আশা না করে তোমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তারা হলেন–মা, বাবা এবং তোমার শিক্ষক। মা, বাবা, শিক্ষক কোনো বিনিময় ছাড়া শিশুদের ভালোবাসে তার ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করেন।
‘এসো সবাই হাসতে শিখি, দেশকে ভালোবাসতে শিখি’ এ স্লোগানকে উপজীব্য করে কিডস কালচারাল ইনস্টিটিউটের ৩৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারি মিলনায়তনে শুরু হয়েছে শিশু উৎসব ও স্কুল থিয়েটার উৎসব।
উক্ত উৎসব উৎসর্গ করা হয় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শিশুদের স্মরণে।
গতকাল ১২ সেপ্টেম্বর উৎসবের ১ম দিনে শিশুউৎসব ও মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শিশুউৎসব ও মিলনমেলার উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি ছিলেন সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. ফরিদুল আলম। আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন শিশু উৎসব উদযাপন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক লেখক, সংগঠক সাইফুদ্দীন আহমদ সাকি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিশু উৎসব উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক শিশু সাহিত্যিক সমাজবিজ্ঞানী ড. সৌরভ সাখাওয়াত।
শিশু উৎসবের মধ্যে ছিল শিশু সমাবেশ, ছোটদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশু কিশোরদের কথামালা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, গুণীজন সংবর্ধনা, শিশু সাহিত্যিক সম্মেলন, শিশু সাহিত্য পাঠ আমরা করবো জয়।
গুণীজন সংবর্ধনা প্রদান করা হয় সমাজ উন্নয়নসংস্থা–ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল এ্যাকশন ইপসা’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ড. আরিফুর রহমানকে। অনুষ্ঠানে শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য কিডস শিশু সাহিত্য সম্মাননা প্রদান করা হয় ছড়াকার মিজানুর রহমান শামিম, গল্পকার ওবায়দুল সমীর, চিত্রশিল্পী পার্থ প্রতীম চৌধুরী, সফল সংগঠকের সম্মাননা পান চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ সভাপতি মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু।
ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের পরিবেশনা পর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা এবং প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মাহাবুবুল হাসান। ছোটদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনা করেন স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা, ঘাসফুল, মমতা কালচারাল ইনস্টিটিউট, ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরাম, সাংস্কৃতিক সংগঠন সৃষ্টি কালচারাল ইনস্টিটিউট, বোধন আবৃত্তি স্কুল ও প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের শিশু কিশোররা। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা পর্বে ছিল ইচ্ছেমত ছবি আঁকা, আবৃত্তি, অভিনয় ও সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা। শিশু থেকে সপ্তম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। ৩য় পর্বে শিশু সাহিত্যিক সম্মেলন ও শিশু সাহিত্য পাঠে ছড়া পাঠ পর্বে সভাপতিত্ব করেন ছড়াকার জসীম মেহবুব ও অধ্যাপক সুপ্রতীম বড়ুয়া। এরপর শুরু হয় কিশোর কবিতা পাঠ ও গল্পপাঠের আসর।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ে তাৎক্ষণিক বেশ কয়েকটি ছোট ছোট প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে উপস্থিত এক শিক্ষার্থী সঠিক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রধান অতিথির কাছ থেকে তাৎক্ষণিক শুভেচ্ছা পুরস্কার গ্রহণ করে। এসময় হল ভর্তি উপস্থিত কবি–সাহিত্যিক–সংস্কৃতিকর্মী, আবৃত্তি শিল্পী ও কিশোরদের করতালিতে পুরো হল মুখরিত হয়ে উঠে।












