সূর্যজ্যোতির পাখির গান

মোহছেনা ঝর্ণা | শনিবার , ১ জুন, ২০২৪ at ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

শহিদ কবি মেহেরুননেসা সম্পর্কে প্রথম জেনেছি কবি কাজী রোজীর কোনো এক নিবন্ধে। তখন শুধু জানতাম কবি মেহেরুননেসা কবি কাজী রোজীর বন্ধু। মিরপুরে তাঁরা পাশাপাশি থাকতেন। ১৯৭১ সালে মিরপুরে বসবাসকারী অবাঙালিরা কবি মেহেরুননেসাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় টিভিতে কাজী রোজীর মুখে আবার শুনেছি কবি মেহেরুননেসার কথা। মেহেরুননেসাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে কসাই কাদের মোল্লা এবং তাদের দোসররা। মেহেরুননেসার মাথাটা তরবারির কোপে শরীর থেকে আলাদা করে তা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে উল্লাস করছিল জল্লাদের গোষ্ঠী। মূলত শহিদ কবি মেহেরুননেসা সম্পর্কে আমি বারবার কবি কাজী রোজীর তেজস্বী কথাগুলোই জানতাম।

এবার বইমেলায় খড়িমাটির স্টলে গিয়ে দেখি “সূর্যজ্যোতির পাখি” নামে শহিদ কবি মেহেরুননেসাকে নিয়ে সাবিনা পারভীন লীনার একটি সংকলন। সংকলনের বিষয়বস্তু এবং প্রচ্ছদ দেখে আগ্রহ করেই কিনে নিলাম। তখনও সংকলন সম্পাদকের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। পরে যখন পরিচয় হলো ততক্ষণে আমি “সূর্যজ্যোতির পাখি”র সূচি উল্টিয়ে দেখে ফেলেছি। সংকলন সূচি দেখেই মনে হচ্ছিল ভালো কিছু পেতে যাচ্ছি।

সংকলনের লেখাগুলো পড়ে শহিদ কবি মেহেরুননেসা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাবে পাঠক মহল। কবি মেহেরুননেসা ১৯৪২ সালে পশ্চিমবঙ্গের খিদিরপুরে জন্মগ্রহণ করে। বাবা আব্দুর রাজ্জাক এবং নূরুননেসার চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন মেহেরুননেসা। মেহেরুননেসার ছোট দুটি ভাই ছিল রফিক আর টগর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁর বাবা আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশে চলে আসেন ১৯৫০ সালের দিকে। মেহেরুননেসার ডাক নাম রানু। দাঙ্গাবেষ্টিত পরিবেশের কারণে রানু ছোটবেলায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি। বড় বোন আর মায়ের কাছেই তার পড়াশোনার হাতেখড়ি। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখেন মেহেরুননেসা। ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসে মেহেরুননেসার পরিবার। কিন্তু এক দেশ থেকে আরেক দেশে এসে ব্যবসা বাণিজ্য কোথাও সুবিধা করতে পারেনি মেহেরের বাবা। বাংলাদেশের মির পরিবারসহ বসবাস শুরু করেন মেহেরুননেসা। ছোটবেলা থেকেই বাবার কাজে সহযোগিতা করতে বাবার ছোট্ট কয়লার দোকানে কাজ শুরু করেন মেহের। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করার সুযোগ না পেলেও মা আর বোনের সহযোগিতায় স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন মেহের। কবিতা লিখে এবং বিভিন্ন পত্রিকার প্রুফ রিডারএর কাজ করে সংসার চালাতেন। তাঁর কবিতার ধার দেখে বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম তাঁকে নিয়মিত কবিতা লেখার পরামর্শ দেন এবং বলেন তার চারপাশের জগৎ, বিরাজমান পরিবেশের কথাও যেন কবিতার বিষয়বস্তু হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে। আর এতে করেই বদলে যায় কবি মেহেরুননেসার কবিতার চরণ। তাঁর “জনতা জেগেছে” কবিতার পঙক্তিমালা কী প্রেরণাদায়ক কয়েকটা লাইন পড়লেই তা প্রতীয়মান হয়। “কবিতা” নামক কবিতাটিও তাঁর শক্তিমত্তার রূপ হয়ে ধরা দেয় কবি মহলে।

সূর্যজ্যোতির পাখি” নামে একটি কবিতার বই করার জন্য ইচ্ছা ছিল কবির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তার আগেই ঘাতকদের নির্মমতার শিকার হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই নিজ ঘরে নিজের চোখের সামনে ছোট দুই ভাইকে হত্যা করতে দেখেছেন। সেই দুঃখ অবশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করার আগেই কসাই কাদেরএর সহচর ঘাতক দালালরা কোপ দিয়ে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে নির্মমভাবে হত্যা করে মাত্র ২৯ বছর বয়সী সাহসী কন্যা কবি মেহেরুননেসাকে। সেখানেও ক্ষান্ত হয়নি। তাঁর মাকেও একই সময়ে হত্যা করে কসাই কাদের গং। মেহেরুননেসার মাথাটি ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়।

এই দেশে জন্মগ্রহণ না করেও এই দেশের প্রতি যে ভালোবাসা নিজের মধ্যে একটু একটু করে ধারণ করেছেন তা তাঁর কবিতা পড়লেই স্পষ্ট ধরা পড়ে।

মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার,

সাত কোটি বীর জনতা জেগেছি, এই জয় বাঙলার।”

জনতা জেগেছে” কবিতার এই দুটি চরণেই কী শিহরণ জাগে মনে!

দেশের জন্য এত বড় ত্যাগ যার সেই একাত্তরের প্রথম নারী শহিদ স্মরণে কী করেছি আমরা! রুখসানা কাজলের লেখায় এত চমৎকার ভাবে শহিদ কবি মেহেরুননেসাকে তুলে ধরেছেন যে যারা মেহেরুননেসাকে একেবারেই জানেন না, এই লেখাটা পড়লে মেহেরুননেসার একটা অবয়ব তাদের চোখেও ভেসে উঠবে।

রুখসানা কাজলের সাথে একাত্ম হয়ে বলছি, “কবির কবিতাগুলোর যথাযথ সম্পাদনা করে ‘সূর্যজ্যোতির পাখি’ বইটি প্রকাশ করা কি অসম্ভব? রাষ্ট্রীয় কোনো সাংস্কৃতিক পুরস্কার এবং ইউনিভার্সিটির কোনো হলের নামকরণ কি করা যায় না কবি মেহেরুননেসার সম্মানে?”

শহিদ মেহেরুননেসার আত্মদান এবং প্রাসঙ্গিক কথা” শিরোনামে জি এইচ হাবীবের রচনাটিতে কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় উঠে এসেছে। জোবাইদা নাসরিনের “মুক্তিযুদ্ধে শহিদ নারী” নামক গ্রন্থের বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে সেই গ্রন্থটি পাঠের একটা ঝোঁক উস্‌কে দিলেন। এজন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি লিখেছেন, “বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত “স্মৃতি ১৯৭১” এর বিভিন্ন খণ্ডে মাত্র চারজন নারী শহিদের কথা জানা যায়। তাঁরা হলেন, শহিদ সাংবাদিক সেলিনা হোসেন, শহিদ কবি মেহেরুননেসা, মাগুড়ার শহিদ লুৎফুন নাহার হেলেন এবং শহিদ ড. আয়েশা বদোরা চৌধুরী।পিরোজপুরের ভাগীরথী, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের আঞ্জুমান আরা, সিলেটের বিয়ানী বাজারের খাসিয়া মেয়ে কাঁকেট প্রাণ দিয়েছিলেন পাকিস্তানিদের হাতেমুক্তিবাহিনীর পক্ষে গুপ্তচরের অভিযোগে। ”

সাবিনা পারভীন লীনা সম্পাদিত “সূর্যজ্যোতির পাখি” নামটি শহিদ কবি মেহেরুননেসার সম্মানে তাঁর অপ্রকাশিত কবিতা বইটির নামেই রেখেছেন সম্পাদক। নামকরণের এই ইতিহাসটুকুর জন্য সম্পাদকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। এই সংকলনে ১৫ টি গুরুত্বপূর্ণ লেখা স্থান পেয়েছে। আমার নিজের মনে সবসময় একটা প্রশ্ন জাগে, এই সংকলন পাঠের পর সেই প্রশ্ন আবার জেগেছে তা হলো এই যে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে কিংবা সহযোগিতায় ঢাকায় নারী ব্রিগেড তৈরি করা হয়েছে, সেই ব্রিগেডের সকল সদস্যদের নামও জানি না। কতজন সদস্য ছিলেন সেই ব্রিগেডে? তাঁদের নাম, পরিচয় জানার কোনো সুযোগ নেই?

শহিদ কবি মেহেরুননেসা সম্পর্কে আরও বড় পরিসরে কাজ হবে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এরকম আরও অনেক অনেক মহীয়সী নারীর কথা উন্মোচিত হবে কোনো না কোনো সাহসী কলমের স্পর্শে এমন আশা জিইয়ে রাখি মনে।

আবারও ধন্যবাদ সম্পাদক সাবিনা পারভীন লীনা। আপনার এই সংকলনের কারণে শহিদ কবি মেহেরুননেসা পৌঁছে যাবেন অনেক পাঠকের অন্তরে। তাতে মেহেরুননেসার প্রাপ্তি কিছু হবে না হয়তো, তবে আমাদের কিছু দায়মুক্তি হবে। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে পারবো, দেখো, দেশপ্রেম কাকে বলে! দেখো, দেশের জন্য বলিদান কাকে বলে! মেহেরুননেসা রচিত সে কবিতার মতো,

সূর্যের বুকে আমরা লাঙ্গল দিয়েছি,

এবার আমরা অগ্নি ফসল ফলাবো

এদেশের মেয়ে নতুন শপথ নিয়েছি

মুগ্ধ মুখর প্রতিভা প্রদীপ জ্বালাবো।”

সূর্যজ্যোতির পাখি

প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

প্রকাশক: খড়িমাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাইলধরের রীনা সিকদার জীবনযুদ্ধে যেভাবে জয়ী হলেন
পরবর্তী নিবন্ধকাপ্তাই লেক থেকে দুই হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ