সু চি : আশা জাগিয়েও হতাশার দিকে যাত্রা

| বুধবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমারের আধুনিক ইতিহাসে অং সান সু চি সব চেয়ে দৃশ্যমান ও একইসঙ্গে বিভাজনকারী রাজনীতিক। তিনি একদিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, মানবাধিকার রক্ষার অক্লান্ত সৈনিক এবং গণতন্ত্রপন্থী বলে স্বীকৃত হয়েছেন, আবার সেই সু চি-কেই দেখা গিয়েছে মিয়ানমারের সেনার সমর্থক হিসাবে, যখন তারা সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করেছে, বিতাড়ন করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সামান্য আগে ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন সু চি-র জন্ম। বর্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক অং সানের মেয়ে। অং সানকে মিয়ানমারে জাতির পিতা বলা হয় এবং তিনি সামরিক বাহিনী তাতমাডোরও প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪৭ সালে তাকে হত্যা করা হয়। তার পরের বছর, ১৯৪৮ সালে বর্মা স্বাধীন হয়।
১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে পড়া শেষ করে দেশে ফেরেন সু চি। তিনি বরাবর বলে এসেছেন, দেশের মানুষকে সেবা করা তাঁর কর্তব্য। কিন্তু ১৯৮৮ সালে ৪৩ বছর বয়সে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ততদিন তিনি শিক্ষাবিদ হিসাবে কাজ করেছেন, তার দুই ছেলেকে বড় করেছেন। ১৯৮৮ সালের অগাস্টে ইয়াঙ্গুনে বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির শ্বেডগন প্যাগোডার সামনে পাঁচ লাখ মানুষের সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে শুরু সু চির রাজনৈতিক জীবন। সু চি তার বাবার উত্তরাধিকার নিয়ে এগিয়ে গেলেন, বললেন, এই আন্দোলন হলো দেশের স্বাধীনতার জন্য দ্বিতীয় সংগ্রাম। এই বক্তৃতাই সু চি-কে বর্মার সব চেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতায় পরিণত করল। তবে এই আশার কিরণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। একমাসের মধ্যেই মিয়ানমারের সেনা জনপ্রিয় আন্দোলন বন্ধ করে দিল এবং সরকারের দখল নিয়ে নিল। তারা নতুন করে নির্বাচন এবং বহুদলীয় শাসনের প্রতিশ্রুতি দিল। কয়েক হাজার মানুষ মারা গেলেন। ১৯৮৯ সালে সামরিক সরকার দেশের নাম বদল করে রাখল মিয়ানমার।
সেনার প্রতিশ্রুতি ছিল ১৯৯০ সালে নির্বাচন হবে। তারা সেই নির্বাচন করালো। সু চি-র দল এনএলডি পার্লামেন্টের পাঁচ ভাগের মধ্যে চার ভাগ আসনে জিতল। তবে সেনা-শাসকরা নির্বাচনের ফলের মর্যাদা রাখেনি। তারা সু চি-কে গৃহবন্দি করে। ১৯৮৯ সালের জুলাই থেকে ২০১০-এর নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ইয়াঙ্গুনে তার বাড়িতেই বন্দি অবস্থায় ছিলেন। ১৯৯০ সালে শান্তির জন্য নোবেল পান সু চি। তার হয়ে তাঁর ছেলেরা সেই পুরস্কার নেন। তিনি সেই পুরস্কারের পুরো অথর্ (১৩ লাখ ডলার) মিয়ানমারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য দান করেন। সু চি-র নোবেল পাওয়ার ফলে তার ও মিয়ানমারের দিকে আন্তর্জাতিক নজর গেল। সু চি হয়ে উঠলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতীক। তার স্বামী মাইকেল অ্যারিস যখন ক্যান্সারে মৃতপ্রায়, তখন সামরিক শাসকরা সু চি-কে জানান, তিনি লন্ডন যেতে পারেন, কিন্তু আর মিয়ানমারে ফিরতে পারবেন না। সু চি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানতেন, একবার দেশের বাইরে গেলে তিনি সত্যিই আর ফিরতে পারবেন না। তাই তিনি দেশে থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১০ সালের নির্বাচনের পর সাবেক জেনারেল থেই সিন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হন এবং সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি মিয়ানমারের দরজাও বাইরের বিশ্বের জন্য খুলে দেন। সু চি মুক্তি পান। তার সামনে তখন বিকল্প ছিল, হয় সেনা যেটুকু রাজনৈতিক কাজ করার অনুমতি দিয়েছে, তা মেনে নিয়ে রাজনীতি করা অথবা অন্য পথে হাঁটা। তিনি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যারা সেনার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, এই সিদ্ধান্ত ছিল তাদের নীতির বিরুদ্ধে। তার সমালোচকরা অবাক হয়ে গেছিলেন। সু চি তাদের বললেন, ‘মানুষ যখন মনে করে, আমি সবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছি, তখন আমিই অবাক হয়ে যাই। আমি রাজনীতি করতে এসেছি, মানবাধিকারের রক্ষক বা মানবাধিকারকর্মী হতে নয়।’ ২০১৫ সালে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি বিপুলভাবে জয়ী হয়। সু চি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কারণ, তার স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ। সংবিধান অনুসারে তাই সু চির পক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি স্টেট কাউন্সিলার হন। এই পদটি বিশেষভাবে তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং এটা ছিল প্রধানমন্ত্রীর সমগোত্রীয়। সারা বিশ্ব জুড়ে মিডিয়া লিখল, অবশেষে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জয় হলো। তবে সেই উচ্ছ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মিয়ানমারে শুরু হলো জাতিগত বিরোধ ও উত্তেজনা। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনা রোহিঙ্গাদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালায়। সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে চলে আসে। জাতিসংঘের মতে, এটা হলো এথনিক ক্লিনসিং-এর টেঙটবুক উদাহরণ। কিন্তু সু চি-র প্রতিক্রিয়া আসে অনেক দেরিতে। তিনি সেনার কাজের সরাসরি নিন্দা করেননি। বরং তঁকে তাঁদের পাশে থাকতে দেখা গিয়েছে। এরপর তাকে দেয়া অনেক সম্মান ফিরিয়ে নেয়া হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের দেয়া মানবাধিকারের পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়। ২০২০-র সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি ও সু চি বিপুল জয় পেলেন। সেনার মদতপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি অভিযোগ করল, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তারপরেই সেনা অভ্যুত্থান হলো। রাজনীতিতে সু চি-র জীবন বৈপরীত্যে ভরা। মাঝেমধ্যেই তাতে অবাক করা মোড় এসেছে, তিনি প্রত্যাশার উল্টো কাজ করেছেন। সোমবারের সেনা অভ্যুত্থানের পরেও ভবিষ্যতে সু চি কী ভূমিকা পালন করবেন, সেটাও সম্ভবত তার হাতে নেই।-ডযেচে ভেল

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান