বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি এখনো বাস্তব রূপ পেয়েছে? আর ২ দিন পরে ৯ ডিসেম্বর, বেগম রোকেয়া দিবস। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পার করছি। অথচ কতোকাল আগেই যে নারী শিক্ষার দ্বারোদ্ঘাটন করে হাজার বছর ধরে নির্যাতিত আর নিষ্পেষিত নারীদেরকে শোষণ, বৈষম্য আর বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করেছিলেন, সেই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন কি এখনো বাস্তবায়ন হয়েছে? তাঁর কল্পিত সুলতানারা কি এখনো নির্যাতন, অনাচার আর বৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়েছে? তিনি কত আগেই শত কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করে নারী শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া নারী তার প্রকৃত পথ খুঁজে পাবে না। নারী তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না কোনদিনও। তাই তিনি সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে নারী শিক্ষার মশাল হাতে নিয়ে সমাজে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মুসলিম সমপ্রদায়ে তখন কেবল আরবি–ফার্সি শিক্ষার প্রচলন ছিল। বেগম রোকেয়া সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় বড় বোন আর ভাইয়ের সহযোগিতায় ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। নিজে তো শিক্ষা গ্রহণ করলেন, সমকালীন পিছিয়ে পড়া নারীদের কিভাবে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন, সেই চিন্তায় তিনি বিভোর ছিলেন। স্বামীর সহযোগিতায় পরে তিনি নারী শিক্ষার পথ খুলেছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী যোগাড় করে তিনি মুসলিম নারীদের জন্য প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু কি স্কুল? তিনি দেখলেন সমাজ তখনও আচ্ছন্ন ধর্মীয় কুসংস্কার আর সেকেলে ধ্যান ধারণায়। তাই তিনি সমাজ থেকে এই কূপমণ্ডুক ধ্যান চিন্তা নির্মূল করতে সামাজিক কার্যক্রম হাতে নেন। সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করে একের পর এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এমন একটি সমাজ চিন্তা করেছিলেন, যেখানে নারীরা থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তিনি দেখেছিলেন, কঠোর পর্দা প্রথার দোহাই দিয়ে সারা পাল্কি কাপড়ে মুড়িয়ে একজন নারীকে নদীতে স্নান করানো হতো। স্নান সেরে ঘরে ফিরলে দেখা যেতো পাল্কির ভেতরে সে নারী মৃত। সেই চিত্র তো আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগকেও হার মানিয়েছে। এই ধরনের বহু পৈশাচিক চিত্র আমরা বেগম রোকেয়ার লেখনিতে প্রত্যক্ষ করি। অথচ এত যুগ, এত কাল পরেও এসে কি আমরা এমন নিরাপদ সমাজ পেয়েছি? স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও কি আমরা এখনো নারীর জন্য একটি সুস্থ, নিরাপদ এবং সহিংসতামুক্ত একটি রাষ্ট্র বা সমাজ পেয়েছি? কোন সুবিধা না পেয়েও শত শত বছর আগে নারীদের কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তায় যে নারী অনেকটা নারী মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তেমন একজন নারীশক্তি কি আমরা পেয়েছি? কারণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন ও মানচিত্র বদল হলেও নারীর জন্য আধুনিক ও উদারনৈতিক কোনো খোলা পথ বা পথের দিশা এখনো আমরা পাইনি। কালে কালে নারী সমাজের কঠিন বেড়াজাল হয়তো ভেঙে বেরিয়ে এসেছে, নারী শিক্ষার হারও বেড়েছে, নারীর পেশাগত দিকও কিছুটা এগিয়েছে, কিন্তু সহিংসতা আর নির্যাতন কমেনি সেই তুলনায়, বরং নির্যাতনের ধরন নানাভাবে ছড়িয়েছে অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জকভাবে। আর এই সময়ে যদি রাজনৈতিক দলের কোন প্রধান ব্যক্তি বলেন, নারীদের বাইরে আসার প্রয়োজন নেই, নারী ঘরেই থাকবে, তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়ায়, তা এখন চিন্তা করার সময়। বিশ্ব জ্ঞানবিজ্ঞান এবং চিন্তা চেতনায় কতদূর এগিয়েছে, অথচ আমরা, আমাদের নারীরা কোথায় আছি। একজন নারীকে সম্মান করে কয়জন পুরুষ? সে যেই হোক কন্যা জায়া কিংবা জননী। হোক শিশু কিশোরী বণিতা বৃদ্ধ! খুব কম সংখ্যক পরিবার আছে, যেখানে নারীর প্রকৃত সম্মান আর মর্যাদা রক্ষা করা হয়। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক কার্যালয় এবং জাতিসংঘ নারী সংস্থা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রতি ১০ মিনিটে বিশ্বে ঘনিষ্ঠ জনের হাতে একজন নারী খুন হয়। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিগত ২০২৪ সালে প্রায় ৫০ হাজার নারী ও মেয়েকে তাদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী বা পরিবারের সদস্যরা হত্যা করেছে। এই তথ্যটি আন্তর্জাতিক নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূল দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে। (তথ্যসূত্র: সংবাদ সংস্থা বাসস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বিশ্বজুড়ে নিহত ৬০ শতাংশ নারী তার সঙ্গী বা আত্মীয়স্বজন যেমন বাবা, চাচা, মা এবং ভাইদের হাতে নিহত হয়েছে। যেখানে পুরুষদের হাতে সংখ্যাটি ১১%। ১১৭ টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, প্রতি বছর ৫০ হাজার নারী, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১৩৭ জন এবং প্রতি ১০ মিনিটে একজন নারী নিহত হয়। এই পরিসংখ্যানটি নারীর প্রতি সহিংসতা এবং লিঙ্গভিত্তিক অপরাধের ভয়াবহতা তুলে ধরে। মোট এই সংখ্যা ২০২৩ সালে প্রকাশিত সংখ্যা থেকে সামান্য কম, তবে প্রকৃতপক্ষে কোন হ্রাস নির্দেশ করে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্য সরবরাহের তারতম্যের কারণেই মূলত এই পার্থক্য দেখা গেছে। নারীদেরকে বাদ দিয়ে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন সম্ভব না। এখন ‘মব জাস্টিস’ এর পাল্লায় পড়ে নারী পুরুষ উভয়েই নিত্য অপমানিত হচ্ছে। বড়–ছোট নারী–পুরুষ কোনো ভেদ নেই, কি একটা অবক্ষয় আর নৈরাজ্য দেশজুড়ে। এই দুঃসময়ে বেগম রোকেয়া দিবসে আজ এই নিবন্ধে কিছু চিন্তাশীল নারীর মতামত তুলে ধরবো। বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন পারভীন মাহমুদ এফসিএ বলেন, অবরুদ্ধ মুসলিম বাঙালি নারীসহ বাংলাদেশে নারী জাগরণে বেগম রোকেয়া ছিলেন অগ্রদূত। নারী শিক্ষা, সামাজিক মুক্তি ও যুক্তিবাদী চিন্তার প্রসারে তিনি অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও লেখালেখি বিশেষ করে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নারীস্বাধীনতা ও লিঙ্গভিত্তিক অগ্রগতির সাহসী কল্পনা উপস্থাপন করে। আজ নারীশিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি ও প্রযুক্তিতে নারী যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে–যা বেগম রোকেয়ার কল্পলোকের পথকে অনেকটা বাস্তব করেছে। তবে লিঙ্গবৈষম্য সমতায় বাধা ও নিরাপত্তাহীন তার মতো চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। বেগম রোকেয়ার সম্মানে আমরা যা করতে পারি তা হলো নারী শিক্ষা ও ঝঞঊগ এ মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, বাল্যবিবাহ ও বৈষম্যমূলক সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা, বেগম রোকেয়ার রচনা পাঠ ও প্রচার করা, কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন অনেকদূর এগোলেও সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরো সচেতনতা, নীতি সমর্থন ও সামাজিক পরিবর্তন দরকার।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের জাতীয় দক্ষতা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সচিব) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, বেগম রোকেয়া যে নারী মুক্তি, শিক্ষা, সমান অধিকার ও সামাজিক স্বাধীনতার লড়াই করেছিলেন, তার অনেকটা আজও পুরো অর্জিত হয়নি। এর কারণ ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে গভীর ভারসাম্যহীনতা প্রোথিত। প্রথমত, শিক্ষার বিস্তার হলেও দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি এখনো বিরাজমান। নারীদের বিদ্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পরিবার ও সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এখনো সীমিত। একই ভাবে ঝঞঊগ, প্রযুক্তি, গবেষণা ও নেতৃত্বে মেয়েদের উপস্থিতি কম। দ্বিতীয়ত, সামাজিক রক্ষণশীলতা ও মানসিকতার ধীর পরিবর্তন, শত বছরের পুরনো মতাদর্শ এখনো রয়ে গেছে। তাই ‘মেয়েদের কাজ ঘরেই’ এই মানসিকতা এখনো বিরাজমান অনেক ক্ষেত্রেই। পোশাক–আসাক, চলাফেরা নিয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ তো আছেই। সেইসাথে নারীর সাফল্যকে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে দেখার মানসিকতা। রোকেয়ার সময়ে যেমন ‘অবনতি’র ভয় দেখিয়ে নারীর মুক্তি আটকে রাখা হতো, আজও প্রায় একই যুক্তি ফিরে আসে। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা। নারী কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও নিরাপদ পরিবেশের অভাব, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, সরকারি পর্যায়ে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য না থাকলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এখনো এই বৈষম্য বিরাজমান। তদুপরি নারীদের উপর পরিবার ও কর্মজীবন–এর ভারসাম্য রক্ষার চাপ তো আছেই। এগুলো নারীকে আত্মনির্ভরশীল হতে বাধা দেয়। চতুর্থত, সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা। নারীর প্রতি সহিংসতা এখন উচ্চমাত্রায়। ডিজিটাল সহিংসতা, যৌন হয়রানি, ঘরোয়া সহিংসতা, বাল্যবিবাহ এগুলো এখনো বিরাজমান। সেই ভয় ও অনিরাপত্তা মেয়েদের জীবন আটকে রাখে, রোকেয়ার সময় থেকে তার বদল হয়েছে ঠিকই, তবে সেই বদল খুবই সীমিত। সর্বোপরি নারী নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব কম। রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, প্রযুক্তিসহ অনেক ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব বেড়েছে কিন্তু এখনো কাঠামোগত বাধা ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতার লড়াই নারীদের পুরো অংশগ্রহণ সীমিত করে। সামগ্রিকভাবে বেগম রোকেয়া নারীর আত্মমর্যাদা রক্ষার যে দলিল সামনে এনেছিলেন, তা এই যুগেও অর্জন হয়নি। আইন, নীতি, শিক্ষা সব অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু মানসিকতা ও কাঠামোগত বৈষম্য এখনো বাধা হয়ে আছে। রোকেয়ার লড়াই তাই শেষ হয়নি, বরং অব্যাহত নানাভাবে, নানারূপে।
মহিলা অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ পরিচালক আতিয়া চৌধুরী বলেন, সময়ের সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির রূপ প্রকৃতিতে ভিন্নতা এসেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি সহিংসতা। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে মাথাপিছু আয়, তবু্ও নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমবর্ধমান। নারী–পুরুষ নির্বিশেষে এই চিন্তার জগৎ– এর উত্তরণ ছাড়া এই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব নয়। নারীর নিজস্ব জগতে নিজের প্রতি ভালোবাসা আর আত্মমর্যাদাবোধ খুব জরুরি। বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার সাথে সাথেই নারীকে সম্মান ও আত্মমর্যাদার বোধ প্রতিষ্ঠা করে স্বাবলম্বী হয়ে বিচরণের মধ্য দিয়ে সহিংসতা ও বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলেছেন। আজকের দিনেও তা বাস্তব। তাই বেগম রোকেয়ার সাহিত্য, দর্শন ও সমাজকর্ম, চিন্তা ও চেতনা, আদর্শ ও কর্মজীবন আজকের দিনেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
মেন্টরস চিটাগাং এর ম্যানেজিং পার্টনার মানজুমা মুর্শেদ বেগম রোকেয়ার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন– নারী অধিকার, শিক্ষা ও স্বাধীনতার যে সাহসী পথ বেগম রোকেয়া দেখিয়েছিলেন, তা আজও আমাদের সমাজকে আলোকিত করে। তাঁর সংগ্রাম শুধু নারীর জন্য নয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক, প্রগতিশীল ও মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখাতে ও আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
চলুন, আমরা বেগম রোকেয়ার দেখানো সমতার আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করি এবং প্রতিটি নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান, সুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাই।










