সময়টা ১৯৭৪–৭৫। তখন দ্বৈত গানের জুটি হিসাবে শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। রাউজানের মদুনাঘাটের একটি অনুষ্ঠানে গান করতে গিয়েছিলেন শিল্পী সঞ্জিত আচার্য্য ও কল্যাণী ঘোষ। সঙ্গে ছিলেন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী আবদুল গফুর হালী। সঞ্জিতুকল্যাণী দুজনই তখনো পর্যন্ত সলো (একক) গান করতেন। হঠাৎ সিদ্ধান্তে সেদিন তারা আবদুল গফুর হালী রচিত একটি ডুয়েট গান (দ্বৈত আঞ্চলিক) ‘ন যাইও ন যাইও/আঁরে ফেলাই বাপর বাড়িত ন যাইও’ গেয়ে দর্শকদের বিপুল সাড়া পান। এই একটি গানই তাদের সংগীত–জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। এরপর মঞ্চে গাইতে গেলেই দ্বৈত গান গাওয়ার অনুরোধ আসে। খুব অল্প সময়েই চট্টগ্রামে সঞ্জিত–কল্যাণী জুটি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেল। এবার এই জুটির গান রেকর্ড করার জন্য এগিয়ে এলো নামী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা। ১৯৭৮ সালে চারটি গান নিয়ে বের হলো সঞ্জিত–কল্যাণী জুটির প্রথম গ্রামোফোন ডিস্ক রেকর্ড। রেকডের্র ‘সত্য গরি হঅনা/কি হইতাম/কঙবাজার লই যাইবা’ এবং ‘ও টেঙিওয়ালা তুঁই কাপ্তাই যাইবা না’ গানগুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আনন্দমেলা ও ঐকতান থেকে প্রায় ২০টি গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয় তাদের। এই জুটির বেশিরভাগ গানের রচয়িতা ছিলেন আবদুল গফুর হালী ও সঞ্জিত আচার্য্য।
এই যে শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের তুমুল জনপ্রিয়তার কালে সঞ্জিতুকল্যাণী জুটির প্রতিষ্ঠা, এটা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। আজ শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী হিসাবে খ্যাত, পাশাপাশি সঞ্জিত আচার্য্য ও কল্যাণী ঘোষকে বলা হয় আঞ্চলিক গানের রাজা ও রানি।
সেই জোড়ের একটি পাখি আজ নেই, উড়ে গেছে অনন্তের পানে। হ্যাঁ, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রাজা সঞ্জিত আচার্য্য গত সোমবার সন্ধ্যায় আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আমরা হারিয়েছি চাটগাঁইয়া গানের তিন কিংবদন্তী শ্যামুশেফালী–গফুর হালীকে। একই মাসে স্তব্ধ হলো সঞ্জিত আচায্যের্র হীরন্ময় কণ্ঠ, থেমে গেল তার ৫ দশকের সংগীত–অভিযাত্রা।
মনে কি পড়ে না সঞ্জিত–কল্যাণী জুটির সেই অমর গান ‘গুরা গুরা কথা কই/বাগানর আড়ালত বই/পিরিতির দেবাইল্যা আঁরে বানাইলা’।
সঞ্জিত আচার্য্য একাধারে গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও নাট্যকার। তার লেখা গানের সংখ্যা সহস্রাধিক। সঞ্জিতের গাওয়া ‘বাঁশখালী মইষখালী’ একটি আইকনিক বাংলা গানে পরিণত হয়েছে। শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, মুজিব পরদেশী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসিমন, শাম্মী আখতার, এন্ড্রু কিশোরসহ বাংলাদেশের দিকপাল শিল্পীরা গেয়েছেন সঞ্জিত আচার্য্য রচিত গান। তার কথা ও সুরে শাম্মী আখতারের গাওয়া ‘সোনাই বন্ধু’ চলচ্চিত্রের ‘আমার মনের বেদনা/বন্ধু ছাড়া জানে না/কোন দেশে গেলে পাব তারে’ গানটি সারা দেশে জনপ্রিয়।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত তার গীতিনাট্য ‘সাম্পানওয়ালা’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, যা সাড়া জাগিয়েছে সারা দেশে। বরেণ্য সংগীত পরিচালক সত্য সাহা সেই ছবির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। আর সেই ছবিতে প্লেব্যাক করেছিলেন শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, সঞ্জিত আচার্য্য ও কান্তা নন্দী। ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবির গান গেয়ে তৈরি হয় সঞ্জিত আচার্য্যুকান্তা নন্দী জুটি। সঞ্জিত–কান্তার গাওয়া ‘বাঁশডুয়ার আড়ালত থাই/আঁরে ডাকর কিয়ল্লাই’সহ প্রায় সব গান গত চার দশক ধরে মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
সঞ্জিত আচার্য রচিত ও গীত সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটি হলো:
বাঁশখালী মইশখালী,
পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই টানে
আয় তোরা কন্কন্ যাবি আঁর সাম্পানে।।
ক্লোজআপ ওয়ানের মতো রিয়েলিটি শো’তে সঞ্জিত আচায্যের্র এসব গান গেয়ে তারকাুখ্যাতি পেয়েছেন নোলক বাবু, সোনিয়ারা।
কিংবদন্তী শিল্পী শেফালী ঘোষের সঙ্গেও দ্বৈতকণ্ঠে আঞ্চলিক গান গেয়েছেন সঞ্জিত আচার্য্য। আবার শ্যামুশেফালী জুটির দারুণ জনপ্রিয় গান ‘ওরে বাস কন্ডাকটার এক্কান সিট অইবনি তোঁয়ার’ বা ‘বাজান গিয়ে দইনর বিলত’ গানগুলোর স্রষ্টাও সঞ্জিত। শেফালী ঘোষের গাওয়া কালজয়ী গান ‘আঁর রসিক বন্ধু আইল না/আঁর তাল্লাই মনে মানে না/সোনা মুখর হাসি দিয়া/বানাইল দিওয়ানা’র স্রষ্টাও তিনি।
সঞ্জিত আচার্য্যের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৯ মে, পটিয়ার চাপড়ায়। পিতা স্বর্গীয় মনোরঞ্জন আচার্য্য। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। মা, স্ত্রী ও তিন কন্যা নিয়ে ছিল সংসার।
সঞ্জিতের পরিবার ছিল সংগীত পরিবার, পিতা ছিলেন পদাবলীর কীর্তিনীয়া। দাদা লক্ষ্মীপদ আচার্য্য চাটগাঁইয়া গানের আরেকজন লিজেন্ড। ভাই মিলন আচার্য্য, ভাইয়ের স্ত্রী লাকী আচার্য্য, বোন গীতা আচার্য্য চট্টগ্রামের জনপ্রিয় শিল্পী।
স্কুল–জীবন থেকেই গান গাওয়া শুরু সঞ্জিত আচার্য্যের। তখনকার দিনের বিভিন্ন শিল্পীর আঞ্চলিক গান তার মনে রেখাপাত করে, সে কথা শুনুন তার মুখেই-‘আমাদের পরিবারে সংগীতচর্চা করা ছিল বাধ্যতামূলক। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে সংগীতে হাতেখড়ি। স্কুল ফাঁকি দিয়ে গাছের ডালে বসে, গলা ছেড়ে গান করতে পছন্দ করতাম। বেতারে কবিয়াল রমেশ শীল, আস্কর আলী পণ্ডিত, মোহাম্মদ নাছির, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার রচিত গান শুনে আমিও গান লেখা শুরু করি। চাপড়া প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় প্রতিযোগিতায় গান গেয়ে সবসময় প্রথম হতাম। এরপর কালারপোল হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে, চট্টগ্রাম সিটি কলেজে বিএ পড়ার সময় বিভন্ন অনুষ্ঠানে গান করার জন্য ডাক আসতে থাকে। এভাবে সংগীতকে মনেপ্রাণে ধারণ করে এগিয়ে চলতে থাকি।’ (সাক্ষাৎকার : নাসির উদ্দিন হায়দার)
১৯৭৩ সাল থেকে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করতেন সঞ্জিত আচার্য্য। তিনি চিত্রনায়ক পংকজ বৈদ্য সুজনের সঙ্গে মিলে ‘চট্টলা নাট্যগোষ্ঠী’ নামে একটি নাট্যদল পরিচালনা করতেন। ১৯৭৫ সাল থেকে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নাটক মঞ্চস্থ শুরু করে চট্টলা নাট্যগোষ্ঠী। নাটক পরিচালনা ও নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতেন পংকজ বৈদ্য সুজন, অঞ্জু ঘোষ, সুব্রত চক্রবর্ত্তী, সেলিনা সালাম, এমএ সালাম, সোমা ভট্টাচার্য (কাজরী)। মঞ্চ নাটকে গান লেখা, সুর ও সংগীত পরিচালনাসহ নেপথ্যে কণ্ঠ দিতেন সঞ্জিত আচার্য্য। সঙ্গে থাকতেন কান্তা নন্দী, উমা খান, কল্যাণী ঘোষ ও গীতা আচার্য্য। এই নাট্যগোষ্ঠী দুবাইয়ে গিয়েও ‘সাম্পানওয়ালা’ নাটক মঞ্চস্থ করে। তার আগে আবদুল গফুর হালীর ‘গুলবাহার’, এমএন আখতারের ‘চুড়িওয়ালা’ আঞ্চলিক নাটক সাড়া জাগায়।
সঞ্জিত আচার্য্য রচিত উল্লেখযোগ্য আরও নাটক হলো ‘সোনাই বন্ধু, মিলন মালা, টাকার গরম, ফুলওয়ালী, বেদকন্যা মালা, প্রেমিক চন্ডিদাশ’। তার অডিও অ্যালবামের সংখ্যা ২০টি। ‘মাটির ঘর, অনুরাগ, ফুলেশ্বরী’ ছবির জন্যও গান লিখেছেন সঞ্জিত।
সঞ্জিত আচার্য্যের গ্রামোফোন ডিস্কের গান রেকর্ড হতো ঢাকার ইপসা স্টুডিওতে। বাজাতেন দেশসেরা যন্ত্রীরা। সংগীত পরিচালনা করতেন সুজেয় শ্যাম, শাহনেওয়াজসহ গুণী শিল্পীরা।
সঞ্জিত রচিত শ্যাম–শেফালীর গাওয়া একটি দ্বৈতকণ্ঠের গান চিরসবুজ গান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। ‘সাম্পানওয়ালা’ চলচ্চিত্রের সেই গানটি হলো :
পুরুষ : ওরে মেহেরজান, আঁর পরানর আদ্দান
মিডা হাসি মারি বুগত, অইন জ্বালালি।
(আঁরে) ঈদ মোবারক গরি বুগর অইন ক্যা নঅ নিভালি।
মেয়ে : ওরে কালা চাঁন, তোর কি সোন্দর মুখখান
আয়না ধরি নিজর মুখ্যান, কেএনে নঅ চাআলি
(আঁর) হাতত ধরি মুখত ধরি প্রেমর জ্বালা বাড়ালি।
এখনো মানুষকে নষ্টালজিক করে সঞ্জিত আচার্য রচিত শেফালী ঘোষের গাওয়া সেই গান :
‘ন লইয়ম ন লইয়ম দুবাইঅলা জামাই আঁই
বিয়া গরি কদিন পরে গেল গই ফেলাই,
তখন হইব কি উপায়।
তিন বছরে একবার আইয়ে দুবাই যারা যায়
ইষ্টকুডুম ন চাই ফিরি, কান্দে বৌ পোয়ায়
চিডিপত্র দিলে কি আর মনর বেয়াগ হউস পোরায়।।
আশির দশকের শেষের দিকে রাউজানের পথেরহাটের শাহ আলম মাইক সার্ভিস থেকে বের হয়েছিল শেফালীুসঞ্জিতের ‘দুবাইঅলা জামাই’ শিরোনামের সেই অ্যালবাম। সারা চট্টগ্রাম তোলপাড় করেছিল সেই ক্যাসেটের গান।
সঞ্জিত আচার্য রচিত কান্তা নন্দীর কণ্ঠে ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবির সেই গান ‘ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে/অভাগীনির দুঃখর কথা হবি বন্ধুরে’ কখনো ভুলতে পারবে বাংলার মানুষ? কিংবা কান্তার গাওয়া ‘কি গান মাঝি হুনাইল হায়রে/কি বাঁশি মাঝি বাজাইল’ গানটি তো কালজয়ী গান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।
সঞ্জিত আচার্য্য সংগীতের একজন বহুমুখী প্রতিভা। গান–নাটক–চলচ্চিত্র, যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। তার হীরন্ময় কণ্ঠ ধারণ করেছে সাগর–কন্যা, বীর চট্টলার মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির সুর। সঞ্জিত আচায্যের্র গানে কর্ণফুলী নদী ও এই নদীর সাম্পান এসেছে বর্ণে ছন্দে, রূপ–লাবণ্যে।
সদর ঘাটা আর চাক্তাই ধরি
অক্কল ঘাডত সাম্পান লই যাই, ঘুরি ফিরি
আঁই তারাতারি হালিশ মারি তার কথা মনে।
তোরা কন্কন্ যাবি আঁর সাম্পানে।
আচ্ছা, শিল্পী কার জন্য, কিসের আশায় সাম্পান চালান? তার মনে কার কথা? সেই পরম বন্ধু, যার কাছে তিনি চলে গেলেন! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হালিশ মারার কী দরকার ছিল দাদা? প্রিয় সঞ্জিত দাদা!
লেখক : সাংবাদিক ও চট্টগ্রামের লোকসংগীত গবেষক