সুরের আকাশে শুকতারা

রওশন আরা বিউটি | বৃহস্পতিবার , ২২ মে, ২০২৫ at ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

নীশিথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা’, ‘ও কী ও বন্ধু কাজল ভ্রমরারে’, ‘ধীরে বোলাও গাড়ি রে গাড়িয়াল, আস্তে বোলাও গাড়ি’ গ্রামবাংলার এমন বহু লোকগান গেয়ে জনমানুষের মন জয় করা উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, গবেষক লেখক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা জামান আব্বাসী ডাকনাম তুলু। বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। আমাদের সঙ্গীত ইতিহাসের গর্ব, লোকসঙ্গীতে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর পিতা ছিলেন পল্লীগানের সম্রাট, মরমী কণ্ঠশিল্পী ও সুরস্রষ্টা আব্বাসউদ্দীন আহমেদ। এ দেশের পল্লিগীতিকে তিনিই প্রথম বিশ্বের সব দেশে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। চাচা আবদুল করিম ছিলেন পল্লিগীতি ও ভাওয়াইয়াভাটিয়ালির জনপ্রিয় শিল্পী। বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদ চেয়েছিলেন, তাঁর সুদর্শন ছেলেটি সিনেমার নায়ক হোক। আব্বাসউদ্দীন আহমেদ শুধু ভাওয়াইয়া গানের গায়ক ও সাধকই ছিলেন না, অভিনেতাও ছিলেন। তিনি অভিনয় করেন ‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘মহানিশা’ (১৯৩৬), ‘একটি কথা’ ও ‘ঠিকাদার’ (১৯৪০) সিনেমায়। অভিনয়ের পাশাপাশি এসব সিনেমায় গানও গেয়েছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন তার এই রূপবান ছেলে চলচ্চিত্রে অভিনয় করুক। এ পথে খ্যাত হোক। কিন্তু বাবার পছন্দের এই দিকটি আকৃষ্ট করেনি মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে। তিনি বরং বাবার খ্যাতির দিকটির প্রতিই আগ্রহী হন। তিনি বাবার সংগীত সাধনার দিকটিতেই নিজের আগ্রহ খুঁজে পান। তাই এ দিকেই নজর দেন। বলা যায়, মুস্তাফা জামান আব্বাসী শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতির প্রায় সব শাখায় সমানভাবে নজর দিয়েছেন। সব দিকেই নিজেকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন। ফলে শিল্পী, সংগ্রাহক, উপস্থাপক, গবেষক, সাহিত্যিক, অনুবাদক ও দার্শনিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি দক্ষতা অর্জন করেন বাংলাইংরেজিউর্দুএ তিন ভাষাতেই। মুস্তাফা জামান আব্বাসী গুণী পিতার গুণী সন্তান। মুস্তাফা জামান আব্বাসীর মা লুৎফুন নেসা আব্বাস বাবার মতোই শৌখিন ছিলেন। ঘরকন্যার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত লিখতেন। ‘শেষ বিকেলের আলো’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৮০ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘কিছু ফুল কিছু স্মৃতি’। ১৬টি প্রবন্ধে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিমূলক এ বইটি তিনি তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে উৎসর্গ করেছেন। তিন নম্বর বই ‘সময় কথা বলে’ জুন ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। বইটি তিনি তাঁর প্রিয় নাতিনাতনিদের উৎসর্গ করেছেন। আব্বাসউদ্দীনের পরিবারের সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিদ্রোহী কবির সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের প্রথম পরিচয় ঘটে কুচবিহারে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। সবার কাছে আব্বাসউদ্দীনকে পরিচয় করিয়ে দিতেন ‘আমার ছোট ভাই’ বলে।

তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ছিলেন তৃতীয়। তাঁর মেঝো ভাই মোস্তাফা জামাল নীলু মাত্র ছয় বছর বয়সে টাইফয়েডে মারা যান। তাঁর বড় ভাই ড. মোস্তফা কামাল ডাকনাম দুলু ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তাঁর একমাত্র বোন ফেরদৌসী রহমান ডাকনাম মিনা একজন সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর বড় ভাইয়ের মেয়ে নাশিদ কামালও সংগীতাঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত। মুস্তাফা জামান আব্বাসী বিয়ে করেন ১৯৬৩ সালের ২০ জানুয়ারি সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাগনি আসমা চৌধুরীকে (পরে আসমা আব্বাসী)। তাঁর স্ত্রী আসমা আব্বাসী একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও লেখিকা ছিলেন। আসমা আব্বাসী গত বছর ৪ জুলাই ২০২৪ সালে মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁদের দুই মেয়ে সামীরা আব্বাসী ও শারমিনী আব্বাসী। সামিরা আব্বাসী লোকসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ও আধুনিক গানের চর্চা ও গবেষণা করছেন। শিকাগোতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন আব্বাসউদ্দীন মিউজিক একাডেমি। শারমিনী আব্বাসী একজন আইনজীবী। বড় বোনের মতোই ক্ল্যাসিক্যাল গানের একনিষ্ঠ সাধক ও গায়ক। মাতৃপিতৃকুলের উত্তরসূরির ঋণেই শারমিনী আব্বাসী হয়ে উঠেছেন নন্দিত লেখক।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী রচিত অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম ‘লোকসঙ্গীতের ইতিহাস’, ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’, ‘রুমির অলৌকিক বাগান’, উপন্যাস ‘হরিণাক্ষি’, স্মৃতিকথা ‘স্বপ্নরা থাকে স্বপ্নের ওধারে’ এবং ইংরেজি জীবনী। বাংলা সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একুশে পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেছেন। একুশে পদক (১৯৯৫)। চ্যানেল আইরবি আজীবন সম্মাননা (২০১১), লালন পরিষদ অ্যাওয়ার্ড, সিলেট মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, নজরুল একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, মানিক মিয়া অ্যাওয়ার্ড, আব্বাসউদ্দিন স্বর্ণপদক (চট্টগ্রাম), বেঙ্গল স্যানিটারি অ্যাওয়ার্ড, নাট্যসভা অ্যাওয়ার্ড; চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, ২০১১; চ্যানেল আই নজরুল মেলা আজীবন সম্মাননা, ২০১৩; এপেক্স ফাউন্ডেশন পুরস্কার; বাংলা শতবর্ষ পুরস্কার ইত্যাদি।

গান, লেখালেখি ও গবেষণা নিয়ে বর্ণিল এক জীবন কাটিয়েছেন তিনি। গানকে কখনো পেশা হিসেবে নেননি মুস্তাফা জামান আব্বাসী। দেশের অনেকেই হয়তো জানেন না মুস্তাফা জামান আব্বাসী আসলে একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষের চিঠি পেতেন, কিন্তু এর একটিও নষ্ট করতেন না। প্রতিটি চিঠিই তাঁর কাছে ভীষণ মূল্যবান। কত রকমের হাতের লেখা। ছোট ছোট অনুভূতির প্রকাশ থাকে এসব চিঠিতে। তাঁর জীবনের অনেক বড় সঞ্চয় এ চিঠি।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। ১০ই মে ২০২৫ শনিবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় বনানীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। মৃত্যুকালে তিনি দুই কন্যা এবং বহু ভক্ত, অনুরাগী রেখে গেছেন। ঢাকার আজিমপুরে মাবাবার কবরে দাফন করা হয়েছে দেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে। ওই কবরফলকে লেখা রয়েছে বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদের সেই বিখ্যাত গানের কলি ‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে’। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গন একজন অভিভাবককে হারালো। মানুষ মরণশীল, যা এক অবধারিত সত্য। তবে কিছু মানুষ তাঁদের মহৎ কর্মের মাধ্যমে মৃত্যুর পরেও স্মরণীয় হয়ে থেকে যান। কীর্তিমান ব্যক্তিরা বেঁচে থাকেন তাঁদের কর্মের মাধ্যমে। শ্রদ্ধেয় মুস্তাফা জামান আব্বাসীও বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের মাধ্যমে অনন্তকাল।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত বিষয়ক গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকাত্তরের শহীদ প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুর হোসেন
পরবর্তী নিবন্ধআহমদ হোসেন খান : একজন কর্মবীরের প্রতিকৃতি