জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী দিলরুবা খান
একটা সময় ছিল বিটিভির যুগ। সে সময় বাংলাদেশের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি এবং এটি ছিল প্রচুর জনপ্রিয় একটি টেলিভিশন চ্যানেল। তখন সবার মনোযোগ থাকতো বিটিভির দিকে। বিটিভি চ্যানেলই আমাদের প্রাণ। বিটিভির দর্শক বাংলাদেশের সব বয়সের মানুষ। তখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল নাটক আর গান।
১৯৮৬ সাল, হুমায়ুন ফরীদি ও সুবর্ণা মোস্তফা অভিনীত বিটিভি’র ‘একদিন যখন’ নাটকের জন্য একটা গান তৈরী করা হয়েছিল। নাটকটির পরিচালক ছিলেন জিয়া আনসারী। গানটা ছিলো- ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল, রেললাইন বহে সমান্তরাল, বহে সমান্তরাল’ সৃষ্টিশীল গীতিকবি নজরুল ইসলাম বাবুর কথায় সুর করেছেন মোহাম্মদ শাহ্ নেওয়াজ। গানটি গেয়েছিলেন তিনজন শিল্পী- মলয় কুমার গাঙ্গুলী, শিশুশিল্পী শামীমা ইয়াসমিন দীবা এবং দিলরুবা খান কিন্তু জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে গিয়েছিলেন দিলরুবা খান। এটাই ছিল টিভিতে গাওয়া তাঁর প্রথম গান। এ গানটি গাওয়ার পর দিলরুবা খানের সঙ্গীত জীবনের উত্থান হয়েছিল, পিছন ফিরে আর তাকাতে হয়নি তাঁকে। একে একে গেয়েছেন আরো অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান।
১৯৯১ সালে রেডিওতে গাইলেন ‘পাগল মন, মন রে… মন কেন এতো কথা বলে…’ বাংলা গানের কালজয়ী এক ইতিহাস এই গান। গীতিকবি- আহমেদ কায়সার, সুরকার-আশরাফ উদাস। এই গান গেয়ে বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী দিলরুবা খান। গানটা সত্যিই মানুষকে পাগল করে ফেলেছিল। হাটে, মাঠে, ঘাটে, ট্রেনে, বাসে, চায়ের দোকানে, বইমেলায় সবখানে বেজেই চলছিল অবিরাম। ‘পাগল মন মন রে…’ দিলরুবা খানকে পৌঁছে দিয়েছিলো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। গানটির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংস্করণ প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন ধারার শিল্পীদের কণ্ঠে। অনেক শিল্পী এই গান গেয়ে পরিচিতি লাভ করেন, যাঁদের মধ্যে দিলরুবা খান অন্যতম। আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছেন দিলরুবা খান। ‘পাগল মন’ এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে তাঁর নামই হয়ে যায় ‘পাগল মন দিলরুবা’। মাঝখানে কিছুদিন সঙ্গীত থেকে দূরে থাকলেও আবারও নিয়মিত হয়েছেন। গাইছেন নিত্যনতুন গান।
অনেকেই হয়তো জানেন না দিলরুবা খানের পুরো নাম। তাঁর পুরো নাম- কানিজ মঞ্জুষা মোসাম্মৎ সৈয়দা দিলরুবা বেগম রুবি দৈতা মধুমতি। তাঁর জন্ম বগুরায়। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন তিনি। খুব আদর করে নামটা রেখেছিলেন তাঁর দাদা। পরে গানের জগতে এসে নিজেই ছোট করে তাঁর নাম রাখলেন দিলরুবা খান। তাঁর ভাইরাও সবাই গান করতে পারে, তবে তাঁরা রেডিও টেলিভিশনে গান করে না। তাঁর মায়ের নাম সালেহা রশিদ। বাবা সৈয়দ হামিদুর রহমান রাজশাহী ও রংপুর বেতারের শিল্পী হলেও তিনি চাইতেন না তাঁর মেয়ে গান করুক। তিনি বলতেন, সৈয়দ বংশের মেয়েরা গান করে না। তবু গানের ব্যাপারে প্রবল আকর্ষণ আর নিজস্ব প্রতিভাই তাঁকে করে তুলেছে লোকগানের পরিচিত শিল্পী দিলরুবা খান। তাঁর দাদা এবং দাদার বাবাও গানের লোক ছিলেন। সংগীত পরিবারের মেয়ে হয়েও নিজেকে প্রচারের জন্য গান করেননি। অডিশনের মাধ্যমে রেডিও-টেলিভিশনে গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
লোকসঙ্গীত শিল্পী আবদুল আলীমের গান গেয়ে গানের জগতে যাত্রা শুরু দিলরুবা খানের। আবদুল আলীমের মৃত্যুর পর একদিন দিলরুবা খান তাঁর বাবার সাথে আবদুল আলীমের বাসায় বেড়াতে যান। আবদুল আলীম ও তাঁর স্ত্রীকে দিলরুবা খান চাচা-চাচীমা বলে ডাকতেন। সেখানে যাবার পর তাঁর চাচীমা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- মা তুমি কি গান করতে পারো? কী নাম তোমার? জবাবে দিলরুবা খান বললেন- জী চাচীমা, আমার নাম রুবি, আমি আলীম চাচার অনেক গান গাইতে পারি। তখন চাচীমা বললেন, ঠিক আছে একটা গান শোনাও তো। দিলরুবা খান আবদুল আলীমের একটি গান গাইলেন- ‘তামারও লাগিয়া রে/ সদাই প্রাণ আমার কান্দে বন্ধুরে/ প্রাণ বন্ধু কালিয়া রে…’ কানাই লাল সেন রচিত এবং সুরারোপিত একটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত। আবদুল আলীম, নীনা হামিদ, সাবিনা ইয়াসমিন, ফেরদৌস আরা, খালিদ হাসান মিলু এবং আরো অনেকে গেয়েছেন গানটি। চিত্রনায়ক ফেরদৌস, চিত্র নায়িকা মৌসুমী ও ইরিন অভিনীত ‘সোনার ময়না পাখি’ সিনেমাতে গানটি ব্যবহার করা হয়। এই গানটি শুনেই তাঁর চাচীমা বলে উঠলেন- বাহ্ কী মিষ্টি একটা গলা। মা তুমি কি গান করতে চাও? দিলরুবা খান বলে উঠলেন জী চাচীমা, আমি গান করতে চাই কিন্তু আমার তো হারমোনিয়াম নেই। একে একে তিনটি গান শোনানোর পর উপহার জুটলো আবদুল আলীমের হারমোনিয়াম আর আশীর্বাদ। দিলরুবা খান বললেন চাচীমা আমি গান শিখবো কার কাছ থেকে। তখন চাচীমা বললেন, ‘কেন, জহির আলীম তোমাকে গান শেখাবে’। তখন মুজিব পরদেশী আবদুল আলীমের সাথে তবলা বাজাতেন সেইজন্য ঐ বাসায় তাঁর যাতায়াত ছিল। মুজিব পরদেশী তবলা বাজিয়ে বাজিয়ে তাল ঠিক করতো। সত্যি কথা বলতে কী জহির আলীমই হচ্ছে তাঁর ওস্তাদ এবং মুজিব পরদেশী তবলা বাজাতেন তাঁকে গান শেখানোর জন্য। দিলরুবা খান তাঁর এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি এই দু’জনের কাছে অনেক অনেক কৃতজ্ঞ এবং সেই সাথে আলীম চাচার ফ্যামিলির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আজকে আমি দিলরুবা হয়েছি আলীম চাচীমা যদি আমাকে হারমোনিয়াম না দিতেন এবং জহির আলীম যদি আমাকে গান না শেখাতেন আর মুজিব পরদেশী যদি আমাকে তবলায় সহযোগিতা না করতেন আমি গান জীবনেও করতে পারতাম না, আমি দিলরুবাও হতে পারতাম না কোনদিন।’
১৯৮৬ সালে যখন বেতারে অডিশন দেন দিলরুবা খান তখন বিচারকের আসনে ছিলেন খন্দকার নুরুল আলম, কাদের জামেরী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সমর দাশ ছিলেন। দিলরুবা খান গাইলেন আবদুল আলীমের গান। গান শুনে খন্দকার নুরুল আলম বললেন, ‘বাপ রে বাপ ছাইয়ের মধ্যে আগুন’।
৯০ এর দশকে তাঁর ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে সে সময়টাতেই হঠাৎ করেই গান থেকে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য আড়ালে চলে যান দিলরুবা খান। বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন হঠাৎ করে তাঁর আড়ালে চলে যাবার গল্প। তিনি বেশ মোটা ছিলেন তাই তিনি যেখানেই যেতেন লোকে তাঁকে উল্টাপাল্টা কথা বলতো, তাতে তিনি খুব দুঃখ পেতেন। হঠাৎ করে তিনি জানতে পারলেন কিছু ঔষধ আছে যা খেলে স্লিম হওয়া যায়। ঔষধ খাওয়ার ৩/৪ দিন পর থেকে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৭টা বছর তাঁর জীবন থেকে চলে যায় এই ঔষধ খাওয়ার কারণে। তিনি যে বেঁচে থাকবেন তাও কেউ বিশ্বাস করেনি। সেই জন্য তিনি তাঁর শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন- ‘কেউ যেন কোনদিনও ওজন কমানোর জন্য কোন ঔষধ না খায়’।
দিলরুবা খান যদিও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য প্রথম ১৯৮৬ সালে নাটকের গান করেছেন কিন্তু তার আগে ১৯৮৪ সালে দিলরুবা খান প্রথম সিনেমার গান করেন ‘রসের বাইদানী’ ছবিতে। পরের বছর ১৯৮৫ সালে ‘রঙ্গীন রুপবান’ সিনেমায় দ্বৈত কণ্ঠে ‘তাজেল’ এর কণ্ঠ দিয়েছেন দিলরুবা খান আর ‘রুপবান’ এর কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা। খন্দকার নুরুল আলমের সুরে, চাষী নজরুল ইসলাম এর ‘বিরহ ব্যথা’ ছবিতে গেয়েছেন কীর্তন ‘বধু যেদিন হইতে তোমারে দেখেছি মরমে গিয়েছি মরে…’ এটি এম শামসুজ্জামানের লিপে।
দিলরুবা খানের অনেক গান জনপ্রিয়তার তুঙ্গ স্পর্শ করেছে। তার মধ্যে কী ভীষণ দরদ দিয়ে গেয়েছেন- ‘ভ্রমর কইও গিয়া/ শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে/ ভ্রমর কইও গিয়া…’ গীতিকবি ও সুরকার রাধারমণ দত্ত। ‘নির্জন যমুনার কূলে বসিয়া কদম্ব তলে বাজায় বাঁশী বন্ধু শ্যাম রাই …’ গীতিকবি – মরমী সাধক দুর্বিন শাহ্। ‘ভুল নিলামে বিকাইয়াছি মন…’ গীতিকবি ও সুরকার – ফকির হজরত শাহ্। ‘আবাল কালের সওদাগর/না খাওয়াইলা দুধের সর রে/ না খাওয়াইলা নারকেল ভাঙ্গা পানি ও মোর সওদাগর/ তোর সাথে আমি বাণিজ্যে যাবো…’ মাটির গান, প্রাণের গান। মুজিব পরদেশীর ‘চিঠির উত্তর দিস রে বন্ধু, যদি মনে লয়, কাগজ গেলো দিস্তা দিস্তা, কলম গোটা ছয়…’ রাধারমন দত্তের ‘প্রেম সেতো জাত কুল মানে না মানে না, কী যে ভুল কী সঠিক জানে না…’ ‘ভাবিনি তুমি চলে যাবে আমায় একা ফেলে…’ গীতিকবি – কায়সার আহমেদ চৌধুরী, সুরকার – আইয়ুব বাচ্চু। এরকম আরও অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন বাংলা লোকগানের মায়াবতী কন্যা দিলরুবা খান। এই পর্যন্ত তাঁর ১৫টি এ্যালবাম বের হয়েছে। কণ্ঠশিল্পী খালিদ হাসান মিলুর (প্রয়াত) সহযোগিতায় প্রকশিত হয় প্রথম একক অ্যালবাম ‘পাগল মন’ ১৯৯১ সালে। এর আগে তাঁর আরো দুটি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে ‘বিজয় বিচ্ছেদ’ আরেকটি ছিল ‘দেখা আরিচার ঘাটে’। তখন কেউ জানতো না, কোনো প্রচার ছিল না। ‘দেখা আরিচার ঘাটে’ এ্যালবামটি বের করেছিলেন হাসান মতিউর রহমান। এ্যালবামের গাওয়া খুব জনপ্রিয় একটি গান- ‘দেখা আরিচার ঘাটে/শাহজালাল ফেরিতে/রংপুরি এক ছোকরা বন্ধুর সাথে রে/রংপুরি এক ছোকরা বন্ধুর সাথে…’ গানটি লিখেছেন ও সুর করেছেন হাসান মতিউর রহমান। এখন তাঁর ইচ্ছে, ১৫টি অ্যালবাম থেকে সেরা ১০টি গান বাছাই করে নতুন একটি অ্যালবাম প্রকাশ করবেন।
দীর্ঘ ২৫ বছর পর সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন দিলরুবা খান। সরকারি অনুদানের শিশুতোষ ছবি ‘পায়রার চিঠি’তে ‘জান রে’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছেন তিনি। ফোক ধাঁচের এই গানটি লিখেছেন ও সুর করেছেন সিনেমাটির পরিচালক নিশীথ সূর্য। গানটির সংগীতায়োজন করেছেন মুশফিক লিটু। দিলরুবা খান দেশের বাইরেও গান গেয়ে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত বিষয়ক গবেষক।