সুরের আকাশে শুকতারা

রওশন আরা বিউটি | মঙ্গলবার , ২৯ জুন, ২০২১ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

সংগীতের অনন্য স্রষ্টা
শেখ ইসতিয়াক

শেখ ইসতিয়াক। আশির দশকের মধ্যভাগে বাংলা আধুনিক গানের নির্মল আকাশে উদিত হয়েছিল যে হালকা আলোয় উদ্ভাসিত নক্ষত্রের- সেই মৃদু আলো সঞ্চারণকারী নক্ষত্রটি সময়ের গতিপথে আলোকিত হয়ে সঙ্গীতের ভুবনকে করেছে আলোকিত। একাধারে সঙ্গীতান্ত্রবাদক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, এবং সঙ্গীত পরিচালক শেখ ইসতিয়াক। অনেকে প্রায়ই ভুল করতেন তাঁর গানকে কিশোর কুমারের ভেবে। যে ক’জন কণ্ঠশিল্পী মেধা আর মননের যৌথ মিশ্রণে দেশের সঙ্গীতে একটি নিজস্ব প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন তাঁদেরই একজন শেখ ইসতিয়াক। খুব অল্প সময়ের জীবনে তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন অসামান্য সব গান। ছন্দময় পশ্চিমা ধাঁচের কণ্ঠে সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক মাতিয়ে রেখেছিলেন গায়ক শেখ ইসতিয়াক। একসময় বাংলাদেশের সঙ্গীতে ‘মেলোডি কিং’ নামে অনেক বেশি পরিচিতি লাভ করেন তিনি। প্রেমের আবেগ যেন বেদনাকেও হার মানায়, আর তাই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথায় ও মকসুদ জামিল মিন্টুর সুরে শেখ ইশতিয়াকের কণ্ঠে ফুটে ওঠে, ‘আমার মনের ফুলদানীতে রাখো তোমার মন, সাজিয়ে দেব যতন করে ফুলেরও মতন’, অসম্ভব সুরেলা কণ্ঠ এবং অসাধারণ গায়কীর জন্যই খুব অল্প সময়ে সকলের মন জয় করে নেন শেখ ইশতিয়াক। তাঁর দরাজ ও মায়াবী কণ্ঠে একেকটি গান যেন হয়ে উঠেছিল নিস্তব্ধতা ভাঙার হাতিয়ার। মাত্র ষোল বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর এক সংগ্রামী জীবনে প্রবেশ করেন শেখ ইসতিয়াক। সেই সংগ্রাম একজন সফল সঙ্গীত শিল্পীর সংগ্রাম। যে সংগ্রাম তাঁকে দিয়েছে খ্যাতি, দিয়েছে জনপ্রিয়তা, সমাজে নিশ্চিত জীবনের এক নিশ্চয়তা।
সদা হাস্যোজ্জ্বল শেখ ইসতিয়াক জন্মেই ছিলেন যেন গানকে সাথে নিয়ে। সেই শৈশবে হাতে তুলে নিয়েছিলেন গিটার। টুং টাং শব্দে বাড়ির আঙ্গিনা মুখর করতেন অহর্নিশ। গলা ছেড়ে গাইতেন ও বেশ। তা দেখে পারিবারিকভাবে মিলে যায় গান বাজনা করার উৎসাহ। তাঁর বাবাও আসামে খুব ভালো গান করতেন। মা’র কাছে ঘটে গানের হাতেখড়ি। এরপর চর্চার পথ ধরে এগিয়ে একসময় মাঠে নেমে পড়েন শেখ ইসতিয়াক। সময়টা ১৯৭০ সাল। শেখ ইসতিয়াক পড়তেন ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীতে। সহপাঠী আরেক তুখোড় গিটারবাদক ও সঙ্গীত শিল্পী হ্যাপি আখান্দকে সাথে নিয়ে শুরু হয় তাঁর বৃহৎ কলেবরের সঙ্গীত সাধনা। প্রায় ৭ বছর ওস্তাদ আখতার সাদমানীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। এরপর সঞ্জীব দের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছেন। তবে সুরের ভুবনে এসেছিলেন গায়ক হিসেবে নয়, বাজিয়ে হিসেবে। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী শেখ ইসতিয়াক বলতেন, প্রথমত আমি গিটারিস্ট, দ্বিতীয়ত আমি কন্ঠশিল্পী।
বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের কিংবদন্তী লাকী আখান্দের ছাত্র ছিলেন শেখ ইসতিয়াক। লাকী আখান্দ খুব বেশি ভালোবাসতেন তাঁকে। একত্রে অনেক গান তৈরি করেছিলেন তাঁরা। ‘৭৪-এর দিকে নিজ উদ্যোগে দাঁড় করান ‘সন্ন্যাসী’ নামে একটি মিউজিক্যাল ব্যান্ডদল। সেই ব্যান্ডদল নিয়ে বছর কয়েক গান বাজনা করার পর ১৯৭৭ সালে গিটার বাদনকে তিনি পুরোপুরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নেন। সমস্ত বড় বড় সঙ্গীত পরিচালকদের নির্দেশনায় গিটার বাজিয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর একটানা প্রফেশনাল গিটারবাদক হিসেবে স্টেজ, টিভি এবং মূলত ছায়াছবিতে প্লে-ব্যাক মিউজিসিয়ান হিসেবে অংশ নেন তিনি। পেশাদার গিটার বাদক হওয়ার পেছনে অগ্রজপ্রতিম লাকী আখান্দ’র কথা বলেছেন, তিনিই তাঁকে টেনে এনেছেন সঙ্গীত ভুবনে।
১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে রিয়াজ উদ্দিন বাদশা প্রযোজিত হানিফ সংকেতের ‘ঝলক’ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার মাধ্যমে শেখ ইসতিয়াক মিডিয়ায় কন্ঠশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮৫ সালে প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘ওগো বিদেশিনী’ ছবিতে। শেখ ইসতিয়াক মূলত একজন আধুনিক গানের শিল্পী। যদিও তাঁর শুরুটা হয়েছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। আধুনিকের পাশাপাশি ফোক গান গাইতেও তাঁর বেশ ভালো লাগতো। ১৯৮৬ সালেই শেখ ইসতিয়াকের গাওয়া মকসুদ জামিল মিন্টুর সুরে আধুনিক গানের প্রথম এ্যালবাম ‘নন্দিতা’ প্রকাশিত হয়। সুপার-ডুপারহিট ব্যবসা করে এ্যালবামটি। শেখ ইসতিয়াকও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে দেশব্যাপী তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। গেয়ে গেছেন একের পর এক। ‘নন্দিতা’র পর শেখ ইসতিয়াকের একক এ্যালবাম বের হয় আরো ছয়টি। সেগুলো হলো ‘দূরের আকাশ’, ‘টিপ টিপ বৃষ্টি’, ‘প্রজাপতির ডানায়’, ‘যদি প্রশ্ন করো’, এবং তুষের আগুন’। সবগুলো এ্যালবাম ই শ্রোতা মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তাঁর সাত নম্বর একক অডিও এ্যালবামটি রেডি ছিল। নিজের করা সুর এবং সঙ্গীত পরিচালনাতে আধুনিক, ফোক, রক, কান্ট্রি মিলিয়ে ১২টি গান সমৃদ্ধ এ্যালবামটির নামও ঠিক করা হয়েছিল। নাম ‘তুমি অভিমানী’। সাউন্ডটেকের প্রযোজনায় বাজারজাতের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারেননি তাঁর সাত নম্বর এ্যালবাম। এ্যালবামটি তাঁর বাবা-মা কে উৎসর্গ করে যান। শেখ ইসতিয়াকের সুর ও সংগীতে শেষ নিবেদন ‘তুমি অভিমানী’ এ্যালবামটিও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পাশাপাশি মঞ্চ ও টিভিতে অসংখ্য গান গেয়েও শেখ ইসতিয়াক ব্যাপক জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘নন্দিতা’ এ্যালবামের ‘নীলাঞ্জনা, ঐ নীল নীল চোখে চেয়ে দেখোনা’, গীতিকার- কাজী আলী তৌফিক, সুরকার- মকসুদ জামিল মিন্টু। তাঁর গাওয়া ‘নীলাঞ্জনা’ তো এক চিরসবুজ প্রশান্তির নাম। ‘একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখি’, শিল্পী ও সুরকার- শেখ ইসতিয়াক, গীতিকার- লিটন অধিকারী রিন্টু। ‘নন্দিতা তোমার কথা ভুলিনি এখনো’, গীতিকার- ডাঃ আরিফ, সুরকার- মকসুদ জামিল মিন্টু। ‘তুমি নেই, আমার কোন অভিযোগ নেই’, গীতিকার ও সুরকার- মাকসুদুল হক। ‘টিপটিপ বৃষ্টি…’, গীতিকার- কাজী আলী তৌফিক। ১৯৮৬ সালে বিটিভিতে ‘ঐবষষড়’ নু খরড়হবষ জরপযরব’ং বিখ্যাত গানটির বাংলায় রূপান্তর (ভাবান্তর) গেয়েছিলেন ‘তুমি আছ আমার মনের গভীরে, আর স্বপ্নরানী হয়ে দিয়েছো মন ভরিয়ে’, লায়নেল রিচির এ গানটা তিনি অনবদ্য ভাবে গেয়েছেন। এই গানের গীতিকার বাংলাদেশের জন নন্দিত উপস্থাপক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত। সুর- মাহবুব পিলু। এই গানটি তাঁর জনপ্রিয়তাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ‘রূপালী চাঁদ জোছনায় মেঘেরা কথা বলে যায়’, গীতিকার ও সুরকার- মকসুদ জামিল মিন্টু। সদ্য প্রয়াত আশি ও নব্বই দশকের জনপ্রিয় পপ সঙ্গীত শিল্পী সাবা তানির সঙ্গেও বিটিভিতে একটি গান গেয়েছেন- ‘আমারও নয়নে নীরবে গোপনে জ্বলে, তোমারই প্রেমেরও শিখা আমারই নয়নেও তা’, গানগুলো শ্রোতাদের মনে আজো স্থান করে আছে। মডার্ন টাইপের গান বাজনা করলেও শেখ ইসতিয়াক একজন শিল্পী হিসেবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে তিনি সবসময় বলতেন, ‘একজন সঙ্গীত শিল্পীকে ভালো শিল্পী হতে হলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়মিত সংগীতের অনুশীলন করতে হবে এবং সুর, তাল, লয় ও উচ্চারণের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান হতে হবে’।সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বহু গুণের অধিকারী শেখ ইসতিয়াক জন্মগ্রহণ করেছিলেন নাটোরে ১৯৬০ সালের ২৩ জানুয়ারি। তাঁর বাবার বাড়ি আসাম। বাবা সরকারী চাকুরে ছিলেন সেই সুবাদে নাটোরে বসবাস করতেন। বাবা মরহুম মোহাম্মদ হোসেন কাস্টমস অফিসার ছিলেন। তাঁরা ছিলেন দুই ভাই ও দুই বোন। বড় বোন শিক্ষক, বড় ভাই চিকিৎসক এবং ছোট বোন পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত। দীর্ঘ ছয় বছর প্রেম করে শেখ ইসতিয়াক বিয়ে করে ছিলেন এক সময়কার মডেল তারকা, নাট্যশিল্পী এবং প্রতিশ্রুতিশীল গায়িকা পুনম প্রিয়ামকে। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারির ২৯ তারিখ এ দম্পতির কোল আলো করে আসে এক কন্যা সন্তান। তাঁর নাম সিমন ইসতিয়াক। বাবার মৃত্যুর সময় মেয়ে সিমনের বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর। রক্তে তাঁর সুর। সিমন পড়াশুনা করেছেন আয়ারল্যান্ডে। শোবিজে আত্মপ্রকাশ করেছেন ‘পিয়ানিস্ট’ হয়ে। বাঙালি মেয়ে হিসেবে সে পেয়েছিল আয়ারল্যান্ডে পিয়ানো কনসার্ট করার সুযোগ। তাঁকে এই অনুমতি দিয়েছিল আইরিশ সরকার। আয়ারল্যান্ডে পড়াশুনারত সিমন ইসতিয়াক ২০০ আইরিশ স্টুডেন্টের মধ্যে ফাইনাল রাউন্ডে ২৫ জন প্রতিযোগীর মধ্যে একজন। বাঙালি মেয়ে হিসেবে এতবড় অর্জন সত্যি এটা গর্বের বিষয়। শেখ ইসতিয়াকের সাধনার ক্ষেত্রে স্ত্রী ছিলেন সবচেয়ে বড় উৎসাহদাতা। তাঁর স্ত্রী পুনম প্রিয়াম চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র প্রোগ্রাম প্রডিউসার ও উপস্থাপক। দীর্ঘদিন ধরে ‘রূপান্তর’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান করছেন তিনি। দেশের বাইরেও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে শেখ ইসতিয়াকের ছিল বেশ নামডাক। বিদেশের মাটিতে অনুষ্ঠান করেছেন অসংখ্যবার। এর মধ্যে কাতার, বাহরাইন, জাপান, আমেরিকা উল্লেখযোগ্য।
পৃথিবীতে কেউই চিরদিনের জন্য নয়। এ সত্যটাকে সাথে নিয়েই মানুষ জন্মায়। কিন্তু এ সত্যটা মেনে নেয়া হচ্ছে সবচেয়ে দুরূহ কাজ। আর এ ক্ষেত্রে জন্ম ও মৃত্যুর ব্যবধান যদি হয় ক্ষণকালের তাহলে তো তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তেমনই না মেনে নিতে পারার মতো এক কঠিন কষ্ট শেখ ইসতিয়াকের অকাল মৃত্যু। ১৯৯৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করেছিলেন প্রতিভাধর এ শিল্পী। প্রচণ্ড স্পষ্টবাদী ছিলেন এই মানুষটি। কিন্তু তাঁর এই স্বভাবের ভেতরেও ছিল নম্রতা। হারিয়ে যাওয়া এই প্রিয় গায়ককে তাঁর ভক্তরা এখনো খুঁজে ফেরেন। বাংলা গানের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন এই শিল্পী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত বিষয়ক গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি এখন হন্যে হয়ে সেই মাকে খুঁজছি
পরবর্তী নিবন্ধমধ্যবিত্তের বিড়ম্বনার নাম ‘বাজেট’