কালজয়ী গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা
কালজয়ী গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কিংবদন্তি কষ্ঠশিল্পী প্রয়াত মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের কণ্ঠে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম…’ গানটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিল। দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে দেশপ্রেমে প্রেরণা যুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ৭১ এর ১৪ মার্চ থেকে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া এই গানটি ছড়িয়ে পড়েছিল সবার কণ্ঠে। সেই কালজয়ী গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে গানটি লিখেছিলেন তিনি। গানটির সুর করেছিলেন মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। বিবিসি’র জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায়, সেরা ২০ গানের মধ্যে ফজল-এ-খোদার লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি রয়েছে ১২তম স্থানে। গানটি আজও শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করে।
ফজল-এ-খোদা ১৯৪১ সালের ৯ মার্চ পাবনার বেড়া থানার বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুহাম্মদ খোদা বক্স এবং মা মোসাম্মাৎ জয়নবুন্নেছা’র তিনি ১ম সন্তান।
ফজল-এ-খোদা একাধারে কবি, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক এবং শিশুসংগঠক। প্রথমে ছড়াকার হিসেবে লেখালেখি শুরু করেন। পরবর্তীতে গীতিকার হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন এবং ভূয়সী প্রশংসা কুড়ান।
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে গান লিখেছেন তিনি। তাঁর গানের ভুবন বিচিত্র- দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, আধুনিক, গণসংগীত এবং চলচ্চিত্রের জন্য গান তো রয়েছেই, তিনি লোকগানও লিখেছেন। একাত্তরের অগ্নিঝরা সেই দিনগুলোর শুরুতে যে সময় দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তখন টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর লেখা ‘সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম/চলবে দিনরাত অবিরাম…’ এ দেশের গণসংগীতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে। স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রের জন্যও তিনি অসংখ্য গান লিখেছেন। ‘এপার ওপার’ চলচ্চিত্রে তাঁর লেখা ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না…’ গানটি সে সময় ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়। গানটির সুরকার ও শিল্পী আজাদ রহমান। শুধু তা-ই নয়, বেতার ও টেলিভিশনের একাধিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পক, লেখক ও নির্দেশক, বেতার মুখপত্র বেতার বাংলার প্রথম সম্পাদক এবং শিশুসংগঠন ‘শাপলা শালুক’-এর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
তিনি ১৯৬৩ সালে বেতারে, ১৯৬৪ সালে টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। শিশু কিশোর সংগঠন শাপলা শালুকের প্রতিষ্ঠাতা ফজল-এ-খোদা এদেশের শিল্পী সমাজের কাছে ‘মিতা ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হলে ফজল-এ-খোদা তাঁর দুঃখ এবং ক্ষোভ গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন, যা সেই সময়ের কল্পনাতীত ঘটনা। বশীর আহমদের সুরারোপে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গাওয়া ফজল-এ-খোদা’র সেই গানটি ছিলো ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো/পথের ধুলোয় লুটোবে/সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন-বিহঙ্গ/সহসা পাখনা লুটোবে/এমন তো কথা ছিলো না’। গানটি ১৯৭৬ সালে রেকর্ড ও বেতারে প্রচারিত হয়।
ফজল-এ-খোদার লেখা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আরও রয়েছে- ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে…’, শিল্পী- জিনাত রেহানা ও শহিদ হাসান, সুরকার- আবেদ হোসেন খান। গানটি ১৯৭২ সালের ১২ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বেতারে রেকর্ড করা হয়। ‘কলসি কাঁখে ঘাটে যায় কোন রূপসী…’, শিল্পী- মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, সুরকার- ধীর আলী। ‘বাসন্তী রং শাড়ি পড়ে কোন বঁধুয়া চলে যায়…’, শিল্পী- খন্দকার ফারুক আহমেদ, সুরকার- ধীর আলী মিয়া। শাবানা ও আলমগীর অভিনীত মনের মানুষ চলচ্চিত্রের গান ‘প্রেমের এক নাম জীবন…’, শিল্পী ও সুরকার- বশির আহমেদ। ‘খুশীর নেশায় আজকে বুঝি মাতাল হলাম গানে…’, শিল্পী- ফরিদা ইয়াসমিন, সুরকার- ওমর ফারুক। ‘দস্যু বনহুর’ ছায়াছবির (১৯৭৪) গান ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়…’, শিল্পী ও সুরকার- আজাদ রহমান, প্রভৃতি। সুরকার আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, কমল দাশ গুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টাচার্য, সত্য সাহা প্রমুখের মতো সঙ্গীতজ্ঞ তাঁর লেখা গানে সুর করেছেন। কণ্ঠ দিয়েছেন বশীর আহমেদ, আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, রথীন্দ্রনাথ রায়ের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা। মূলত ছড়া দিয়ে তাঁর লেখালেখি শুরু। তাঁর ছড়াগ্রন্থের সংখ্যা ১০টি আর কবিতা গ্রন্থ ৫টি। এছাড়াও গান, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা ৩৩টি।
ফজল-এ-খোদা ৪ জুলাই ২০২১ সালে রোববার ভোর চারটায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রখ্যাত এই গীতিকার করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি গভীর ডিমেনশিয়া ও কিডনি রোগেও আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি ৩ পুত্র, স্ত্রী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ঢাকার রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা ফজল-এ-খোদা তাঁর সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে সংগীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত বিষয়ক গবেষক