আল–হাশর পবিত্র কুরআনের ৫৯ নম্বর সূরা। এটি মদিনায় অবতীর্ণ। মোট আয়াত ২৪টি। দ্বিতীয় আয়াতের হাশর শব্দ থেকে সূরাটির নামকরণ। এর অপর নাম হলো সূরা বনু নাজির। হজরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রা.) বলেন আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কে বললাম এটি হাশর। তিনি বললেন একে বনু নাজির বলো কেননা এ সূরায় মদিনা থেকে বনু নাজির গোত্র বহিষ্কারের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বর্ণিত সূরায় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আল্লাহতায়ালার গুণাবলি মুসলমান কর্তৃক বিজিত অঞ্চলে সম্পদ বণ্টন মুনাফেকদের আচার–আচরণ ও তাওহিদের আলোচনা স্থান পেয়েছে।
সূরা হাশরের শানে নুজুল ও ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা : মদিনা থেকে দুই মাইল দূরে বনু নাজিরের বসবাস। তারা নবী করিম (সা.) এর সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। এ অবস্থায় নবী করিম (সা.) তাদের মহল্লায় গেলে তারা তাঁকে একটি ছাদের নিচে বসতে দেয়। পরে ছাদ থেকে পাথর গড়িয়ে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহতাআলা ওহির মাধ্যমে তাঁকে এ বিষয়ে জানানো হলে তিনি জায়গাটি থেকে সরে যান। তাদের জানিয়ে দেন তোমরা চুক্তি ভঙ্গ করেছ। তোমাদের যেখানে ইচ্ছা চলে যাওয়ার জন্য ১০ দিন সময় দেওয়া হলো। এরপর তোমাদের কাউকে পাওয়া গেলে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। এতে মহান আল্লাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি গুণবাচক নাম উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ তার সুন্দর সুন্দর নাম এই তিন আয়াতের মধ্যে তুলে ধরেছেন। তাই সকাল–সন্ধায় এই তিন আয়াত পাঠ করলে অনেক সওয়াব ও কল্যাণ অর্জন করা যায়।
মুনাফিক সরদারের প্ররোচনায় তারা দেশ ত্যাগ করল না। নবী করিম (সা.) চতুর্থ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে তাদের পাড়া ঘেরাও করেন। নিরুপায় হয়ে তারা নতিস্বীকার করলে নবী করিম (সা.) আবারও তাদের সুযোগ করে দিয়ে বললেন অস্ত্র ছাড়া যতটা পারো জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে এখনই এলাকা ত্যাগ করো। আদেশ মেনে তারা দেশত্যাগ করল। কেউ চলে গেল খাইবার উপত্যকায় কেউ সিরিয়ায়। সুরাটির শেষ তিন আয়াতে আছে তিনি আল্লাহ তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। তিনি পরম করুণাময়। (সুরা হাশর)
সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের বাংলা উচ্চারণ : হুআল্লা হুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়া, আলিমুল গাইবী ওয়াশ শাহাদাদি হুয়ার রাহমানুর রাহিম। হুআল্লা হুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল মালিকুল কুদ্দুসুস সালামুল মু’মিনুল মুহাইমিনুল আজিজুল জাব্বারুল মুতাকাব্বির। ছুবহানাল্লাহি আম্মা য়ুশরিকুন। হুআল্লাহুল খালিকুল বা–রিউল মুছাওয়িরু লাহুল আসমাউল হুসনা। ইউছাব্বিহু লাহু মা ফিস–সামাওয়াতি ওয়াল আরদ ; ওয়া হুয়াল আজিজুল হাকিম।
সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের অর্থ : তিনি আল্লাহ তিনি ছাড়াা কোনো উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। তিনি পরম করুণাময় পরম দয়াময়। তিনিই আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনিই মালিক, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, নিরাপত্তাবিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অহংকারের অধিকারী। ওরা যাকে শরিক করে আল্লাহ্ তার থেকে পবিত্র, মহান। তিনিই আল্লাহ্, সৃজনকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা, রূপদাতা, সব সুন্দর নাম তাঁরই। আকাশ ও পৃথিবীতে যা–কিছু আছে সমস্তই তাঁর পবিত্র মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, তত্ত্বজ্ঞানী। (সুরা হাশর : আয়াত : ২২ থেকে ২৪)
পাঠের ফজিলত ও আমল : হাদিস ও তাফসির গ্রন্থে সূরা হাশরের বেশ কিছু ফজিলত ও আমল উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে সূরা হাশর পাঠ করতেন। ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ঘুমানোর আগে মুসাব্বিহাত সূরাগুলো পাঠ করতেন। এগুলোর মধ্যে এমন একটি আয়াত আছে যে আয়াতটি এক হাজার আয়াত অপেক্ষা উত্তম। মুসাব্বিহাতের মধ্যে সূরা হাশর অন্তর্ভুক্ত। সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত অনেক বেশি। সকাল–বিকাল সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সওয়াবের আমল। হজরত মাকাল ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি সকাল বেলা সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত তিলাওয়াত করবে। আল্লাহ ওই ব্যক্তির জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করেন ; যারা উক্ত ব্যক্তির জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকে। আর এ সময়ের মাঝে যদি লোকটি মারা যায় তাহলে সে শহীদের মৃত্যু লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এটি সন্ধ্যার সময় পড়বে তাহলে তার একই মর্যাদা রয়েছে। সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। এতে মহান আল্লাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি গুণবাচক নাম উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ তার সুন্দর সুন্দর নাম এই তিন আয়াতের মধ্যে তুলে ধরেছেন। তাই সকাল–সন্ধায় এই তিন আয়াত পাঠ করলে অনেক সওয়াব ও কল্যাণ অর্জন করা যায়।
হাদীসে পাকে রয়েছে প্রত্যেক নামাযের পর এস্তেগফার, আয়াতুল কুরসি, কুল শরীফ ইত্যাদি পাঠ করা সুন্নাত। আর সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত কুরআনে পাকেরই অংশ। তাই সেগুলো ফজর ও আসরের জমাতের পর তেলাওয়াত করতে কোন অসুবিধা নেই বরং উত্তম। তাছাড়া সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন।
বনু নাজিরের শেষ পরিণতি : ইতিহাস সাক্ষ্য যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকদের শেষ পরিণতি হয় ভয়ঙ্কর। বনু নাজিরকে ওয়াদা ভঙ্গ নবী হত্যার ষড়যন্ত্র ও ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের জন্য কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত–বনু নাজির এবং বনু কুরায়জা গোত্রদ্বয়ের ইহুদিরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে যুদ্ধ করেছিল। রাসূল (সা.) বনু নাজিরকে দেশান্তর করেন এবং বনু কুরায়জাকে সেখানে থাকার অনুমতি দিয়ে তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন কিন্তু বনু কুরায়জাও যুদ্ধ করল। ফলে তিনি তাদের পুরুষদের হত্যা করলেন এবং তাদের নারী, শিশু ও সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। কিন্তু তাদের কিছুসংখ্যক লোক যারা রাসূল (সা.) এর সাথে মিলিত হয়েছিল তাদের তিনি নিরাপত্তা প্রদান করেন। তখন তারা মুসলমান হয়ে যায়। রাসূল (সা.) মদিনার সব ইহুদিকে দেশান্তর করেন। বনু কায়নুকা গোত্রের ইহুদি (আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের গোত্র) বনু হারিছার ইহুদি এবং মদিনায় বসবাসরত সব ইহুদিকেই দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের ফজিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহতাআলা সবাইকে সকাল ও সন্ধ্যায় সুরা হাশরের এই তিন আয়াত তেলাওয়াতের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট