১৮৫৪ সালে বৃহত্তর ভারতবর্ষের এপার বাংলায় সিলেট ভ্যালীর মালীনিছড়া নামক স্থানে সর্বপ্রথম বাণিজ্যকভাবে চা উৎপাদন করার জন্য বৃটিশরা সুদূর ভারতের ওড়িশা, জঙ্গলময় ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন অনগ্রসর জায়গা থেকে রেলপথে চা শ্রমিকদের নিয়ে আসেন। এসব শ্রমিকদের নিয়ে আসার সময় তাদের সাথে কথা ছিল জমিসহ আবাসন সুবিধা দেয়া হবে এবং তাদের একটি মোটামুটি উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা হবে। এসব চা শ্রমিকদের এতদূর থেকে আনার পর বৃটিশরা তাদের কথা রাখেনি, ফলে চা শ্রমিকরা বৃটিশ চা বাগান মালিকদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট ভ্যালির প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক ‘মুল্লুক চল’ শ্লোগান দিতে দিতে চাঁদপুরঘাট পর্যন্ত চলে আসে কিন্তু বৃটিশ পুলিশ এদের বাঁধা দেয় এবং সংঘর্ষ সংঘটিত হয় এবং এতে বৃটিশদের সৈন্যদের হাতে বেশকিছু চা শ্রমিক মারা যায়।
সেদিন থেকে প্রতিবছর চা শ্রমিকরা এদিনটিকে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করলেও রাষ্ট্রেীয় পৃষ্ঠপোশকতার অভাবে এদিবসটির তেমন কোনো প্রচার প্রচারণা লক্ষ্য করা যায় না। এদিনটি আসলেই সিলেট এলাকার কিছু চা শ্রমিক চোখের জল ফেলে নীরবে স্মরণ করে যায়। মূলত ১৮৫৪ সালে চা শ্রমিকদের যা জীবনমান ছিল বর্তমান সময়ের চা বাগানগুলোতেও চা শ্রমিকদের জীবনমানের তেমন একটা উন্নতি ঘটেনি কম মজুরি, কুসংস্কার, শিক্ষা সুযোগের অভাব তদুপরি চা বাগানের গণ্ডির বাইরে পা না বাড়ানো ইত্যাদি কারণে চা শ্রমিকরা এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
তথ্যমতে বাংলাদেশে ছোটবড় ১৬৭ টি নিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে। তারমধ্য ১৩৭ টি চা বাগানই সিলেট এলাকায়, ফলে এসব এলাকায় চা শ্রমিকের কাজ করতে এক ব্যাপক সংখ্যক চা শ্রমিকের প্রয়োজন এবং বর্তমানে এসব চা বাগানে প্রায় ৭ লাখের মত চা শ্রমিক কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে এদেশে শুরু থেকেই চা শ্রমিকরা বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। চা শ্রমিকরা বৃহত্তর ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসার একেবারে প্রথমদিকেই তাদের মজুরি দেয়া হতো খুবই কম এবং তাদের আবাসন সুবিধা ছিল না বললেই চলে, তারা নিজেরাই বিভিন্ন ছোটছোট পাহাড়ের ঢালে মাটির ঘর তৈরি করে থাকতো।
বৃটিশ নিয়ন্ত্রিত চা বাগান সমূহে তাদের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য শক্তপোক্ত ডাকবাংলোর ব্যবস্থা থাকলেও শ্রমিকরা ছিলো মূলত অবহেলিত। চা বাগানের গণ্ডির মধ্যে থাকাতে চা শ্রমিকদের অধিকাংশই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাদের সন্তানসন্ততিরা জন্মের পর থেকে তাদের পিতামাতাদের চা শ্রমিকের কষ্টকর জীবনযাপন করতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় তারাও ছোট বয়স থেকে একই কাজে অভ্যস্থ হয়ে যায়। এতে করে তারা বাইরের জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না। চা বাগানের অধিকাংশ শ্রমিকদের এককথা তাদের পূর্বপুরুষরা চা বাগানে কাজ করেছে তারাও করছে এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মও চা বাগানের কাজ করবে এতো লেখাপড়া শিখে কী হবে। মূলতঃ কমমজুরি তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দিকে তেমন একটা ধাপিত করে না। তারা কোনো মতে খেয়ে দেয়ে জীবনে বেঁচে থাকতে চায়। এদেশের চা বাগান সমূহের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে
ইংরেজ লেখিকা ক্যারো লাইন অ্যাডামস তার ‘সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে’ গ্রন্থে সিলেটে চা-বাগানের উষালগ্ন সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘প্রথম দিকের বাগান মালিকেরা তাদের দুর্ব্যবহারের জন্য ছিল কুখ্যাত, মদ্যপ, বাগানগুলো অব্যবস্থাপনার শিকার এবং শ্রমিকেরা বঞ্চিত ও অব্যবহৃত। বাগান শ্রমিকদের অত্যধিক খাটানো হতো, তাদের বাসস্থান নিম্নমানের এবং মজুরি ব্রিটিশ মালিকদের মুনাফার তুলনায় খুবই নগণ্য।’ অন্যদিকে চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিষয়ক জরিপের রিপোর্টও অত্যন্ত ভয়াবহ,
২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম জরিপটি চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এই জরিপে দেখা গেছে, অপুষ্টির কারণে চা-বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বাকার, ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়। স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
এই জরিপের তথ্য অনুযায়ী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ কিশোরীর, মা হয়ে যাচ্ছে ২২ শতাংশ। এ ছাড়া ন্যূনতম স্যানিটেশন-সুবিধা নেই চা-বাগানের ৬৭ শতাংশ পরিবারের।
শ্রমিকদের সংকট সন্তানদের শারীরিক গঠনেও প্রভাব ফেলছে এর আগে ২০১৮ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) মৌলভীবাজারের চা-বাগানগুলোর নারীদের ওপর একটি গবেষণা চালায়। এতে দেখা যায়, প্রায় ১৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যানসারে ভুগছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্বল্পমজুরি, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার অভাব, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কারের কারণে এমন অপুষ্টি আর রোগের শিকার চা-বাগানের নারী ও শিশুরা।
প্রকৃতপক্ষে চা শ্রমিকদের এসমস্ত বিষয়ে মালিক, শ্রমিক এবং চা বিষয়ক উর্ধতন কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে ভাবতে হবে। চা শ্রমিকদের সন্তানরা যাতে শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ পায় সে বিষয়টি মালিকপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে মজুরি বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিষয়ে সচেতনতা এবং শ্রমিকদের মন থেকে কুসংস্কার দূর করা ইত্যাদি বিষয়ে মালিক পক্ষের নজর দেয়ার সময় এসে গেছে তা না হলে চা শ্রমিকদের পরবর্তী প্রজন্ম এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হবে। প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে এসমস্ত চা শ্রমিকদের বিশেষ সাহায্য দেয়া উচিত।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, চা শ্রমিকদের শ্রমে এবং ঘামে আমরা এ চা পাচ্ছি এবং তা বাইরে দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছি। আমরা প্রত্যাশা করবো সরকার, বাগান মালিকপক্ষ উভয়ে মিলে যুগযুগ ধরে এসমস্ত নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে জরুরি পদক্ষেপ নেবেন।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।