সুবর্ণদুয়ারে দাঁড়িয়ে

জাহেদুল আলম | শুক্রবার , ২৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

‘সংস্কৃতি কথাটাই একটু অতীতমুখো। সবাই জানে অতীতের জন্য কিছুই করার নেই। অতীতের উন্নতি করা সম্ভব নয়, ক্ষতি করাও নয়। আমাদের যা কিছু করার থাকে তা বর্তমানের জন্যই। সামনের দিকে খানিকটা তাকাতে পারি বটে, ভবিষ্যৎ যাকে বলি , বর্তমানের মাথার উপর সোনালি একটা পাড় লাগিয়ে নিতে পারি, সেটাকে বলতে পারি দূরদৃষ্টি। আবার বর্তমানকে ভবিষ্যতের কালো অন্ধকারের ঘেরাটোপ দিয়ে ঢেকে দিতেও পারি। তবে যাই করি না কেন, একশো ভাগ মনোনিবেশ বর্তমানে দাঁড়িয়ে দিতেও পারি। কারণ ভবিষ্যৎ অনাগত, অতীত খরচ হয়ে যাওয়া সময়, বিগত। তবে টান কেন পিছনে দিকে?’
সদ্য প্রয়াত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক রচিত ‘আধুনিকতা, লোকযাত্রা ও সংস্কৃতির রূপান্তর’ প্রবন্ধের প্রারম্ভিক বক্তব্য উপর্যুক্ত বাক্য কয়টি। আবার তাঁর ‘জনসাধারণ: সংস্কৃতিকর্মীর দায়’ প্রবন্ধে আছে – ‘বাংলাদেশের একজন সংস্কৃতিকর্মী কাজ করতে গিয়ে কী ধরনের সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে? কেমন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে? বাহিরের প্রতিবন্ধকতা বা ভিতরের প্রতিবন্ধকতা? খুব জরুরি প্রশ্ন এটা। তবে সচরাচর আমরা এই প্রশ্ন নিজেদের করি না।’
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি ও জিজ্ঞাসাগুলোর জবাব পেতে পাঠক শরণাপন্ন হতে পারেন ‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় ৪৫ পেরিয়ে’ প্রকাশনায়। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় ৪৫ পেরিয়ে’। অরিন্দমের এখন সাতচল্লিশ বছর চলছে। চট্টগ্রামের অরিন্দম আত্মপ্রকাশ করে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে। আদি ও বর্তমান ঠিকানা ৬০ হাইলেভেল রোড, লালখান বাজার, চট্টগ্রাম।
‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি। ধর্মের আগাছা বেশি।’ -কালজয়ী এই উক্তি সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর, তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসের। লালসালু নিয়ে মঞ্চনাটক, বেতার ও টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। কিন্তু যারা অরিন্দমের লালসালু নাটক দেখেছেন, তাঁদেরকে বলতে শোনা গেছে- সব মাধ্যম মিলে অরিন্দমের লালসালুই সেরা। পাণ্ডুলিপি, নির্মাণ ও অভিনয় সব মিলিয়ে। নাটকটি যৌথভাবে নাট্যরূপ দিয়েছেন শিশির দত্ত ও মুনির হেলাল। নির্দেশনা দিয়েছেন শিশির দত্ত। ‘এই অরিন্দমের জন্ম না হলে, শিমুল ইউসুফের জন্ম হতো না। কারণ আমি প্রথম নাটক করি অরিন্দমের নাট্যমঞ্চে।’ মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফ দীর্ঘদিন এই কথাটি বিভিন্ন বক্তব্যে বলে আসছেন। অরিন্দমের আমন্ত্রণে ঢাকা থিয়েটার চট্টগ্রামে নাটক করত আসলে, সেখানে এক নাটকীয় ঘটনায় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে অভিষেক হয় অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফের। কথিত আছে, মঞ্চের তুখোড় অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী টেলিভিশন নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় অরিন্দমের আমন্ত্রণে চট্টগ্রামের মঞ্চে নাটক করতে এসে।
নাটকের দুই দিকপাল মমতাজউদ্‌দীন আহমদ ও জিয়া হায়দার প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের সাথে। বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ঘরানায় সূচনালগ্নের দল অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়। মঞ্চসারথি আতাউর রহমান লিখেছেন, ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, অর্থাৎ আমাদের নাটকের দল এবং চট্টগ্রামের অরিন্দম এর নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল প্রায় কাছাকাছি সময়ে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তীকালে আমাদের দেশে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চার উন্মেষ ঘটে। আমরা আমাদের দেশের নব নাট্যচর্চার সূচনালগ্নে নাটক মঞ্চায়ন করতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। সেখানে সেন্ট মেরিস স্কুলের মঞ্চে আমরা আমাদের নাটক মঞ্চায়ন করেছিলাম। নাটক ছিল ‘বাকি ইতিহাস’, ‘তৈল সংকট’ ও ‘বিদগ্ধ রমণীকুল’। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দর্শকেরা টিকেট কিনেছিল। আমরা খুব আনন্দচিত্তে তদানীন্তন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের কাঠের ফ্লোরে পাশাপাশি শুয়ে, আড্ডা দিয়ে রাত্রিযাপন করেছিলাম। সেইসব আজ মধুর স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে। আমাদের বিদায়ের সময় চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে দুপক্ষের নাট্যকর্মীরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। সদরুল পাশাকে জড়িয়ে ধরে আমি অনেক কেঁদেছিলাম। অরিন্দম এর সদস্য সদা কর্মঠ ও উদ্যোগী হেলালের চেহারাও আজ স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে।’
লেখার সূচনালগ্নে হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধের উদ্ধৃতিতে যে আছে ‘তবে টান কেন পিছনের দিকে?’ – চর্চার দিক থেকে এই টান আছে বলেই ব্যতিক্রমী সাড়ে নয় বাই সাত ইঞ্চি সাইজে চারশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ঢাউস এক প্রকাশনা করতে পেরেছে অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়। প্রকাশনাটিতে শুধু যে অরিন্দমের বিষয়আশয় চিত্রিত হয়েছে তা নয়। আমাদের নাট্যচর্চার অনেক বিষয়আশয়ও বিধৃত হয়েছে। যেহেতু অনেক সময় নিয়ে অরিন্দম কাজটি করেছে, সেহেতু আমাদের নাট্যচর্চা সম্পর্কে আরও তথ্যবহুল করার সুযোগ ছিল। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার না করায় বঞ্চিত হলো পাঠক।
প্রকাশনাটি বারটি অধ্যায়ে বিন্যাস্ত। ‘সদরুল পাশা স্মরণ’, ‘শোকগাথা যাঁদের আমরা হারিয়েছি’, ‘বছরসূচি: অরিন্দমের নাটক’, ত্রিশজনের লেখা সমৃদ্ধ ‘আমি ও অরিন্দম’, ‘অরিন্দমের নাটক: আলোচনা’ অধ্যায়। এই অধ্যায়ে অরিন্দমের ষোলটি নাটকের তেতাল্লিশটি সচিত্র আলোচনা-সমালোচনা আছে। অরিন্দমের বিভিন্ন নাটকের পোস্টার ও বিভিন্ন আমন্ত্রণপত্র নিয়ে রঙ্গিন একটি অধ্যায় আছে। আছে প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯৭৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ে যুক্ত হওয়া সব সদস্যদের তালিকা এবং আরও অনেককিছু।
‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় ৪৫ পেরিয়ে’ উৎসর্গ করা হয়েছে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ ও অধ্যাপক জিয়া হায়দারসহ বাংলাদেশের সকল নাট্যকর্মীকে। প্রচ্ছদ করেছেন ২০২১ সালে অকালপ্রয়াত শিল্পী খালিদ আহসান (সম্ভবত এটা তাঁর করা শেষ প্রচ্ছদ)। নামলিপি, নন্দন তত্ত্বাবধান ও ভাবনাচিত্রে ছিলেন মইনুল আলম। মুদ্রিত হয়েছে চট্টগ্রামের মোমিন রোডস্থ পূর্বা থেকে। সংযুক্ত সম্পাদক কমল সেনগুপ্ত, আবসার হাবিব, মুনির হেলাল, আহমেদ নেওয়াজ, সুব্রত বড়ুয়া রনি, আকবর রেজা, সাইফুল আলম বাবু ও কাজল সেন। শ্রদ্ধার্ঘ্য-তে মুদ্রিত ‘টুঙ্গীপাড়ার অমর সমাধীতে / ছোপ ছোপ রক্তের যে গোলাপ ফুটে আছে/ তা হাজার লক্ষ নিযুত কোটি কোটি/ মানুষে মানুষে ছড়িয়ে পড়ুক।’
‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় ৪৫ পেরিয়ে’ এর ‘আমি ও অরিন্দম’ অধ্যায়ে কমল সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘অরিন্দম-এর সাথে মমতাজউদদীন স্যার সরাসরি যুক্ত থাকলেও অরিন্দম জিয়া হায়দারকেও সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল। এটার পেছনে ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা। তখন যারা অরিন্দম- এর নেতৃত্বে ছিল, তারা এটা করতে পেরেছে। সদরুল-শিশির এরা তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। আমিও কমবেশি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। সেই সময় সদরুল চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র সংসদে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদপ্রার্থী। শিশির তখন চট্টগ্রাম ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। এসব শুরুর দিকে নাটকে অনেককে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করেছিল।’
অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি সদরুল পাশা (১৯৫৪-১৯৯৫) লিখেছেন, ‘আমি অরিন্দম, এটা বিশ্বাস করেছিলাম। আজ থেকে অনেকদিন আগে… নামটার মানে জানো? অরিন্দম মানে যে শত্রুকে দমন করে। মানেটা বলেছিল শিশির।’ এই শিশির মানে নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির দত্ত, অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক সভাপতি। শিশির দত্ত সম্পাদনা করেছেন ‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় ৪৫ পেরিয়ে।’ আর মাত্র কয়েক বছর পরই অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায় সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। সুবর্ণ জয়ন্তীতে শিশির দত্ত কী উপহার নিয়ে উপস্থিত হন- সে অপেক্ষায়।
লেখক: নাট্যকর্মী ও শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুই দেশের সম্পর্ক জোরদারের তাগিদ
পরবর্তী নিবন্ধভূঁইয়া ইকবাল