সু–বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে কলুষিত আত্মাকে পবিত্র করণের নাম আধ্যাত্মবাদ। আধ্যাত্মিকতা আত্মসম্বন্ধীয় ইবাদত। আত্মসাধনায় যাঁরা সফলকাম হয়েছেন; তাঁদেরকে ইসলামী পরিভাষায় সুফি বলে।
সুফির পরিচয় দিতে গিয়ে হযরত দাতাগঞ্জ বক্স (কাশফুল মাহজুব গ্রন্থে) লেখেন, ‘ওই ব্যক্তিই সুফি; যিনি প্রেমের পবিত্রতায় পূত হয়েছেন, প্রেমাস্পদে নিবেদিত হয়েছেন এবং পার্থিব সবকিছুকে পরিত্যাগ করেছেন’। তিনি আরো বলেছেন, ‘যিনি পবিত্রতা অনুশীলন করেন, প্রবৃত্তিকে দমন করেন, সত্যকে গ্রহণ করে জীবন পরিচালিত করেন এবং সবধরনের পার্থিব ইন্দ্রিয় থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর সাথে মিলিত হন; তিনিই সুফি’। যাঁরা কঠোর আধ্যাত্মিক চর্চায় নিমগ্ন হয়ে ফানাফিল্লাহ্ স্তর পেরিয়ে (বাকাবিল্লাহ্) আল্লাহত্ব অর্জন করেন, আল্লাহর গুণে গুণান্বিত, রূপে রূপায়িতসহ একাকার ধারণ করেছেন; তাঁদের আউলিয়া (আল্লাহর বন্ধু) বলে। আউলিয়াগণ আল্লাহর শক্তি অর্জন করে বেলায়তপ্রাপ্ত হয়ে স্তরবিশেষে গাউস, কুতুব, আবদাল, আকতাবসহ এমনকী বেলায়তের সর্বোচ্চ স্তর (মজজুবে সালেক রূপে) গাউছুল আজম অর্থাৎ বেলায়তের সুপ্রিম অথরিটি প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর ইশারায় দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতকে পরিচালনা করে থাকেন।
আউলিয়ারা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত; তাই জ্ঞানে, দয়া বিতরণে, ক্ষমায়, কল্যাণকারী সহ সার্বিকভাবে আল্লাহর গুণসমূহ এঁদের চরিত্রে পরিলক্ষিত হয়। সুফি–আউলিয়াদের এক কথায় চিহ্নিত করা যায় তা হল তাঁদের অপরিসীম বিনয় ও উদারতা। এঁদের উদারতা, বিনয়, কল্যাণকারিতা, মেহমানবৎসল মনোভাব দ্বারা সকল ধর্মানুসারীকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। সর্বধর্ম সমন্বয়, জীবে প্রেম, সমপ্রীতির বন্ধন রয়েছে তাঁদের চেতনায়। উঁচু নিচু, ধনী–দরিদ্র, মুসলমান–হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিস্টান, যেকোনো ধর্মমতসহ কোনো বৈষম্য করে না। সকলকে আত্মার চোখে দেখেন। ফলে সকল ধর্ম–সমপ্রদায় যুগে যুগে তাঁদের সম্মানের সাথে গ্রহণ করেছে। কারণ যে কর্ম করুক না কেন সকলে দিনশেষে মানসিক শান্তি চায়। সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে যে শান্তির পরশ পাওয়া যায় সুফিদের নিকট। মানসিক শান্তি, আত্মশুদ্ধি, আত্মার মুক্তি সহ পার্থিব ও অপার্থিব চাওয়া পাওয়ার জন্য সুফিদের চরণে নিজেকে নিবেদন করে। প্রেমাকর্ষণ, আধ্যাত্মিক সোহবতের জন্য সকলে তাঁদের খানকাহ্–মাজারে নিয়মিত আসা–যাওয়া করেন। ধীরেধীরে দরবার –খানকাহ্ হয়ে ওঠে সকল জাতির মিলন কেন্দ্র। স্রষ্টায়িগুণের কারণে সকলেই তাঁদের আদর্শ, চিন্তা, চেতনা সহজেই গ্রহণ করে। ধর্মের নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে সকল ধর্মের অনুসারীকে সহজিয়া ধারার মাধ্যমে নীতি নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধসহ স্রষ্টামুখি করেছেন। সুফিরা ডোমিনেশন নয়, কো–অপারেশনে বিশ্বাসী। ভেদাভেদ, কর্তৃত্ব নয় বরং সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সব ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিতসহ বিশ্বকে একটি পরিবার ভেবে বিশ্বমানবতার কল্যাণে সকলকে নৈতিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। প্রেম–ভালোবাসা, উদারতা দিয়ে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। যুগে–যুগে আউলিয়াগণ বিভিন্ন হেকমত, বিজ্ঞান, কৌশল প্রয়োগ করে সহজিয়া ধারার মাধ্যমে সকল সমপ্রদায়কে খোদাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন, যেটি রক্ষণশীল ধারার মাধ্যমে কখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি। এজন্য সুফিধারা ও রক্ষণশীল ধারার মধ্যে আকাশ–পাতাল পার্থক্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে যুগসংস্কারক ফরদুল আফরাদ, গাউসুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদউল্লাহ(ক.) মাইজভাণ্ডারী যুগসংস্কারক হিসেবে আগমন করে উন্মুক্ত আধ্যাত্মবাদ তরিকার মাধ্যমে জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ধর্মসাম্যের ভিত্তিতে এক তাবুর নিচে একত্রিত করে আধ্যাত্মিক চর্চা করার পথকে আরো সহজ ও সুগম করেছেন। কেউ কারো মত ও পথে বাঁধা নয়। বিভিন্ন ধর্মের চিন্তা ও চর্চার পথ, আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন হলেও নৈতিক চর্চা সকলের অভিন্ন এবং গন্তব্য সকলেরই এক, তা হল–স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন। সেটি হযরত কেবলা উপলব্ধি করে ধর্মের নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে যুগসংস্কারক হিসেবে উন্মুক্ত আধ্যাত্মবাদের মাধ্যমে নতুনত্ব আনয়নপূর্বক ধর্মসাম্য নীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর ধারাবাহিকতায় ফটিকছড়ি মতি ভাণ্ডার দরবার শরিফ, আমিরভাণ্ডার দরবার শরিফসহ সকল দরবারে ধর্মসাম্যের চর্চা চর্চিত হয়। এভাবে দরবার ও খানকাহ্সমূহ সকলের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সকল ধর্মানুসারি এই তাবুর নিচে নিরাপদে আশ্রয় গ্রহণ করে। এখানে সামপ্রদায়িকতা ও বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। সকলকে আত্মার দৃষ্টিতে দেখা হয়। তাই সকলেই আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে আউলিয়াগণের সোহবতে ছুটে যায়। আউলিয়ারা খোদার জাত। খোদাগুণের বহিঃপ্রকাশ এঁদের মধ্যে দেখা যায়। আল্লাহ আস্তিক, নাস্তিক সকলকে রিজিক দান করেন এবং আল্লাহর রহমতের দরজা সবসময় খোলা থাকে। বান্দা অজস্র ভুল করলেও ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেন; বেলায়তধারী আউলিয়ার দরবার থেকেও কেউ খালি হাতে ফেরে না। এঁদের দয়ার দরজা সকলের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত থাকে। পরোক্ষভাবে আল্লাহর নেয়ামত–গুণ, শক্তি, মর্যাদা, সব খুঁজে পাওয়া যায় আউলিয়ার দরবারে। তাই সেখানে সকল ধর্মানুসারির অবাধ বিচরণ পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা প্রেম –মহব্বত, স্নেহ ভালোবাসা, উদারতা দিয়ে সকলকে কাছে টেনে আল্লাহর দিকে ধাবিত করেছেন। কষ্টিপাথরের সংস্পর্শে স্বর্ণ যেভাবে খাঁটি হয়, আউলিয়াদের প্রেমের পরশে পাপিষ্ট আত্মাও পূর্ণমানবে পরিণত হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়–হযরত পীরানেপীর দস্তগীর শেখ সৈয়দ আবদুল কাদের(ক.)জিলানীর খানকাহ্‘র মজলিসে ইহুদি–খ্রিস্টানও বসতেন। (তথ্যসূত্র: গ্রন্থ –বাহজাতুল আসরাব)। পীরানেপীর দস্তগীর(ক.) বলেছেন, ‘খোদার বন্ধুদের সোহবত গ্রহণ কর, তাঁরা যার প্রতি দৃষ্টি দেবেন, তাঁর রুহানি জীবন আরম্ভ হয়ে যায়, তিনি যদি ইহুদি, নাসারা, মজুসিও হয় তবুও। আর যদি মুসলমান হয়; তবে ঈমান আরো দৃঢ় হয়।’ (তথ্যসূত্র; গ্রন্থ– ফাতহুর রব্বানী)। ভারতের প্রসিদ্ধ হযরত ওয়ারেস আলী শাহ্ (রহ.)’র ভক্তদের মধ্যে মুসলমান ধর্মের অনুসারীর পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের ভক্ত–শিষ্যও ছিলেন। এঁদের মধ্যে ঠাকুর পঞ্চম সিং, রাজা উদয় নারায়ণ সিং, বাবু নিশার, ঠাকুর গৌরমহান শিং, জমিদার ডি.টি অন্যতম। একইভাবে গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মহিউদ্দিন(ক.), হযরত ফরিদ উদ্দিন গেহরবি (রহ.), হযরত সোলায়মান তাও্ঁসবি(রহ.), মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ থেকে কবিয়াল রমেশ শীল, গুরু দাস ফকির, ধনঞ্জয় বড়ুয়া, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ থেকে সুবল দাস আধ্যাত্মিক কামালিয়তপ্রাপ্ত হয়েছেন। এভাবে সুফির সকল দরবার থেকে সব ধর্মানুসারিরা প্রতিনিয়ত জাগতিক ও আধ্যাত্মিক দয়া পাচ্ছেন; যার অসংখ্য নজির বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতেও পাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ রসূলেপাক (দ.)’র পদাংক অনুসরণকারি আলোপ্রাপ্ত সুফিদের দরবারে ফয়েজ–রহমত কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। এঁরা সকলের সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন বলেই আখেরি জমানায় আউলিয়াদের দরবার–খানকাহ্সমূহ সকলজাতির নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং জাগতিক –আত্মিক শান্তি ও মুক্তির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি এগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ ইয়াতিমখানা, হেফজখানা, লঙ্গরখানা, বিভিন্ন ধাতব্য চিকিৎসালয়, যেগুলোর মাধ্যমে মানবতার বৃহৎ কল্যাণ হচ্ছে। জন্মথেকেই দেখছি–সুফির প্রভাবে এদেশে সর্বধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানসহ যার যার ধর্ম পালন করে আসছে। কিন্তু রক্ষণশীল ধারার কতক শ্রেণি শিরক–বেদআতের ফতোয়া দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে সুফিবাদ, দরবার –খানকাহ্ থেকে দূরে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত। সকলধর্মের সহাবস্থানকে ধ্বংস করে বিভেদ সৃষ্টিই তাদের লক্ষ্য। তারা সুফিদের উদার চিন্তাধারাকে অগ্রাহ্য করে কট্টরতাকে প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে পরিকল্পিতভাবে আহলে বায়াত প্রেমিকদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে মাজার–খানকাহ্ ধ্বংসের উৎসবে মেতেছে। তারা এ দেশে সুফিদের দ্বারা প্রাপ্ত শান্তি সমপ্রীতি ও অসামপ্রদায়িক চেতনাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের অপচেষ্টায় লিপ্ত। কোনো সভ্য জাতি এই অনৈতিক কর্মকে সমর্থন করতে পারে না। এটি নিন্দনীয় কাজ। বাংলাদেশ সুফিদের অবাধ বিচরণভূমি। অগণিত সুফি আউলিয়াদের পদচারণায় বাংলাদেশের মাটি পবিত্রময় হয়েছে। বাংলার মত সর্বধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পৃথিবীর কোথাও নেই। সুফিরা আল্লাহ ও রসূল(দ.)কে চেনার পথকে সুগম করেছেন। হাদিসে আছে, ‘আউলিয়াগণ আল্লাহর সুবাস’। শান্তির সুবাস অনুভব করা যায় আউলিয়ার দরবারে। সুফি এবং সুফিবাদ এদেশে ধর্মপ্রাণদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে বহু পূর্ব থেকেই। এদেশে সুফিবাদের শেকড় অনেক গভীর। মানুষ সবসময় সত্য ও শান্তির সন্ধান করে, যা সকলে খুঁজে পায় সুফিদের খানকাহ্ ও দরবারে। এজন্য সুফিরা সর্বকালে সর্বধর্মের লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য। তাই আখেরি জামানায় উম্মতে মোহাম্মদীসহ সকল ধর্ম, সকল সমপ্রদায়ের শান্তি, মুক্তির নিরাপদ আশ্রয়স্থল ; সুফি –আউলিয়ার দরবার–খানকাহ্।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক, সাজ্জাদানশীন,
মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ।