সুপেয় পানি নিয়ে উদ্বেগ ওয়াসার

কর্ণফুলী-হালদায় পানি কমার তিন কারণ চিহ্নিত

শুকলাল দাশ | শনিবার , ১৮ মে, ২০২৪ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামবাসীর প্রতিদিনের ৫০ কোটি লিটার সুপেয় পানির যোগান দিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার চারটি পানি শোধনাগার। ওয়াসার এই চারটি পানি শোধনাগার প্রতিদিন হালদা এবং কর্ণফুলী থেকে মিঠা পানি পরিশোধন করে নগরীতে সরবরাহ করে। বছরের ছয় মাস (মে থেকে অক্টোবর) কর্ণফুলী এবং হালদায় পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসা নির্বিঘ্নে পানি উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু যত বিপত্তি নভেম্বর থেকে এপ্রিল; এই ছয় মাস হালদা এবং কর্ণফুলীতে পানি প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। তখন চট্টগ্রাম ওয়াসাকে নগরবাসীর প্রতিদিনের চাহিদা মোতাবেক পানি উৎপাদনে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত এক দশক ধরে কর্ণফুলী নদীতে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) পানি প্রবাহ ক্রমশ কমতে থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা; বেড়েছে উদ্বেগ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ওয়াসার একটি বিশেষজ্ঞ টিম (ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে) কালুরঘাট থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত নদী পথে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এসময় বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্যরা নদীর কোন জায়গায় পানির লেভেল কত সেটা পরীক্ষা করেন এবং বছরের পাঁচছয় মাস নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ তাদের পর্যবেক্ষণে শনাক্ত করা হয়।

এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের লাইফ লাইন কর্ণফুলীকে নিয়ে এখনই ভাবা দরকার। কর্ণফুলী মরে গেলে চট্টগ্রামে বিপর্যয় নেমে আসবে। হালদাও প্রায় মরে গেছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পানি প্রবাহ এবং নাব্যতা দুটোই কমে গেছে হালদা এবং কর্ণফুলীতে।

নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কর্ণফুলী এবং হালদায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে আমাদের ৪টি পানি শোধনাগার প্রকল্পে পানি উৎপাদন অনেকাংশে কমে যায়। নদীতে যে গভীরতা থাকার কথা সেই গভীরতা নেই। নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা নেই কোথাও। আমরা গত মার্চে ওয়াসার ইঞ্জিনিয়ারদের একটি টিম কালুরঘাট থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছি। এসময় আমরা বিভিন্ন স্থানে নদীর নাব্যতা পরীক্ষা করেছি। প্রায়ই জায়গায় নদীর নাব্যতা কমে গেছে। বিশেষ করে রাঙ্গুনিয়ার পর থেকে বিভিন্ন পাহাড়ি বনাঞ্চলে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে, পাহাড় কাটা হচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ি কাদামাটি নদীতে পড়ছে। নদীর পানির মধ্যে কাদার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে, অপরদিকে আমাদের পানি শোধনাগারে পানি পরিশোধন করার ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার এই বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আরো বলেন, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কর্ণফুলীহালদায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার তিন কারণ আমরা প্রাথমিক ভাবে চিহিৃত করেছি। এ কারণগুলো হলনদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, নির্বিচারে গাছ এবং পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ি মাটি নদীতে পরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। তবে এর চেয়েও বড় কারণ হল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কাপ্তাই লেক থেকে এই সময়ে পানি নির্গমণ না হওয়া। হালদায় সারা বছর যে সব শাখা ও উপ খাল থেকে পানি প্রবাহ হয়ে থাকে শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) শাখা খালগুলো থেকে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকে। এখানে রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে, সেচ কাজের জন্য এই সময়ে স্থানীয় কৃষকরা স্লুইচ গেট বন্ধ করে দেয়। ফলে হালদা এবং কর্ণফুলীর পানি প্রবাহ কমে যায়।

কর্ণফুলী এবং হালদাকে বাঁচানোর জন্য এখনই চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসা উচিত। এই ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপও দরকার। কাপ্তাই লেক খনন করতে হবে। কর্ণফুলীর এই অংশে নিয়মিত ডেজিং করতে হবে। নির্বিচারে বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটা এবং পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে।

আগামী মাসে চট্টগ্রাম ওয়াসার ভাল্ডালজুরি পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৭ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হবে। এই প্রকল্পটি কর্ণফুলী নদী থেকে পানি উৎপাদন করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি নির্গমণ একেবারেই কমে যায়। যার ফলে হালদা নদীতে মিঠা পানির প্রবাহের পরিমাণ কমে যায়। এ সময় হালদায় উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ায় কর্ণফুলী নদীর জোয়ারের লবণাক্ত পানি হালদায় প্রবেশ করে। হালদা নদীর যে পয়েন্ট থেকে ওয়াসা মোহরা প্রকল্পের পানি সংগ্রহ করা হয় সেখানে গত এপ্রিল মাসে লবণের পরিমাণ প্রতি লিটারে ১৭০০ মিলিগ্রাম ছিল। স্বাভাবিক সময়ে এই লবণের পরিমাণ থাকে প্রতি লিটারে ১০০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম। একই অবস্থা মদুনাঘাটস্থ শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্পেরও। এভাবে পানির প্রবাহ যেমন কমতে থাকেতেমনি বাড়তে থাকে লবণের মাত্রা। এই অবস্থা আগামীতে অব্যাহত থাকলে আগামী ৩৪ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামবাসী সুপেয় পানির বিপর্যয়ে পড়বে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম ওয়াসার ৪টি পানি সরবরাহ প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প১ ও শেখ হাসিনা পানি শোধরাগার প্রকল্প২ প্রতিদিন ২৮ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে কর্ণফুলী থেকে। অপরদিকে শেখ রাসেল পানি শোধনাগার প্রকল্পটি প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে হালদা থেকে (মদুনাঘাট)। আর মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে প্রতিদিন ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হয় হালদা থেকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকেএনএফের নারী শাখার প্রধান আকিম বম গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবান বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ ৩ জন বরখাস্ত