বিশ্বের তিনভাগ জল, একভাগ স্থল। এতো বিশাল জলের ভাণ্ডার থাকার পরও সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির জন্য সারা বিশ্বের মানুষের আজ হাহাকার। বেঁচে থাকার জন্য পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পণ্য। পানি ছাড়া বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন জীব বেঁচে থাকতে পারে না। অনেক জীব নোনা জলে সারভাইভ করতে পারে, তবে বেশির ভাগ ভাস্কুলার গাছপালা এবং বেশিরভাগ কীটপতঙ্গ, উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি বেঁচে থাকার জন্য বিশুদ্ধ মিষ্টি পানি প্রয়োজন। আবার বিশুদ্ধ পানি সব সময় পানযোগ্য হয় না। একসময় পৃথিবীর বেশির ভাগ স্বাদু পানি (ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ) কোনো প্রকার ট্রিটমেন্ট ছাড়াই মানুষের ব্যবহারের উপযুক্ত ছিলো। তবে মানুষের কর্মকাণ্ড ও প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন ক্ষয়জনিত কারণে সেই মিঠা পানি আজ দূষিত। বর্তমানে ফ্রেস ওয়াটার বিশ্বের মোট পানির ৩% এর ও কম এবং এর মাত্র ১% সহজে পাওয়া যায়। আবার পরিবেশ থেকে আহরিত বিশুদ্ধ পানির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক পানি চক্রের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাদু পানি পুনরায় পাওয়া যায়। যেখানে সমুদ্র, হ্রদ, বন, ভূমি, নদী এবং জলাধার থেকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ হয়ে বৃষ্টিপাত হিসাবে আবার ফিরে আসে। তবে যদি প্রাকৃতিকভাবে পুনরুদ্ধার হওয়ার চেয়ে মানব ক্রিয়া কলাপের মাধ্যমে বেশি পরিমাণে পানি ব্যবহৃত হয়,তবে ভূ–পৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে ফ্রেস ওয়াটারের প্রাপ্যতা হ্রাস পেতে পারে।লাগাতার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করলে পানির লেয়ার নীচে নেমে যায়।এতে ভুমিধস ও মরুকরণ সহ মারাত্মক সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।আবার পানি দূষণ মিষ্টি পানির প্রাপ্যতা কমিয়ে দেয়।তাই মানুষ দূষিত ও বর্জ্য পানি পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তি তৈরি করেছে।
পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে পানের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও বিশুদ্ধ পানি হিসেবে বিবেচনা করা হয় বৃষ্টির পানিকে। বিশুদ্ধ পানির চাহিদা সবখানে, তবে এটি সহজ লভ্য নয়। একসময় বিশুদ্ধ পানির বড় উৎস ছিল ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক পানি। এখনো গ্রামাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিই বিশুদ্ধ পানির বড় উৎস। শহর এলাকায় এই জায়গা দখল করে নিয়েছে বোতলজাত পানি। আবার পানি বিশুদ্ধকরণের ফিল্টারও এখন ঘরে ঘরে। সুস্থভাবে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি আবার আমদানিও করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে দুই ধরনের পানি আমদানি হয়। এক. প্রাকৃতিক খনিজ পানি। দুই. বিশুদ্ধ পানি। জানা যায়, বাংলাদেশে পানি আমদানি শুরু হয় প্রায় ২৫ বছর আগে। শুরুতে বিদেশি বোতলজাত পানির ব্যবহার ছিল খুবই কম। তবে ধীরে ধীরে আমদানি করা পানির ব্যবহার বাড়তে থাকে। শুরুর দিকে দুই একটি প্রতিষ্ঠান বোতলজাত পানি আমদানি করতো। চাহিদা বাড়ায় এখন ২০–২২টি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে পানি আমদানি করে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ফ্রান্সের এভিয়ান ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি। ফ্রান্সের আল্পস পর্বতের ঝরনার পানি প্রাকৃতিকভাবে পরিশোধন করে বোতলজাত করে এভিয়ান কোম্পানি। বিশ্বখ্যাত এই ব্র্যান্ডের প্রাকৃতিক পানির কদর সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ফিজি, একুয়া পান্নাসহ নানা ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানিও আমদানি হচ্ছে। মূলত ৩৩০ এমএল, ৫০০ এমএল ও দেড় লিটার বোতলে পানি আমদানি করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গত পাঁচ বছরের পানি আমদানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরে গড়ে সাড়ে তিন লাখ লিটার বোতলজাত পানি আমদানি হয়। এর মধ্যে গত বছর পানি আমদানি করা হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার লিটার যা অন্যান্য বছরের চেয়ে কিছুটা কম। গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি পানি আমদানি হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর আমদানি হয়েছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার লিটার। পানি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যানুযায়ী, দেশে বোতলজাত পানির বাজার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। এই বাজার নিয়মিত বড় হচ্ছে। তবে আমদানি পানির বাজার বেশি বড় নয়। রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে পানি আমদানিতে ব্যয় হয় ১ লাখ ১৫ হাজার ডলার এবং সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকার বাজার রয়েছে বিদেশি পানির।
জানা যায়, তারকা হোটেলে যে বিদেশি অতিথিরা আসেন তাঁরা সব সময় বিদেশি পানি পান করেন। এ ছাড়া কিছু প্রবাসী ও নব্যধনী শ্রেণির মানুষ বিদেশি পানি পান করেন। এই গ্রাহকদের চাহিদার কারণে তারকা মানের হোটেলগুলোতে ও সুপার শপগুলোতে আমদানিকৃত পানি রাখা হয়।
বিশ্বের সবদেশেই বোতলজাত পানির অভ্যন্তরীণ বাজার বেশ বড়। প্রতিটি দেশেই পানির স্থানীয় ব্র্যান্ড রয়েছে। এ কারণে বৈশ্বিক পানি আমদানি রপ্তানির বাজার খুব বেশি বড় নয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে পানি রপ্তানির বাজারের আকার ছিল ৪৩৩ কোটি ডলারের। বিশ্বে পানি রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ফ্রান্স। এছাড়া চীন, ইতালি, ফিজি ও বেলজিয়াম বড় রপ্তানিকারক দেশ।
তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পানি আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে দেশটি ১০২ কোটি ডলারের পানি আমদানি করে। এ ছাড়া হংকং, বেলজিয়াম,জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসও বড় আমদানিকারক দেশ।
দামি পানি আমদানি হলেও বাংলাদেশ থেকে পানি রপ্তানিও হয়। তবে আমদানির মতো প্রাকৃতিক পানি নয়, বোতলজাত বিশুদ্ধ খাবার পানি রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে প্রাণ–আরএফএল গ্রুপ বোতলজাত পানি রপ্তানি করে আসছে। চলতি বছর পানি রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বা এমজিআই।
প্রাণ গ্রুপ মাউন্ট ফ্রেশ ও ইউরো ফ্রেশ ব্র্যান্ড নামে বোতলজাত পানি রপ্তানি করছে। তারা মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে, পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ আফ্রিকায় পানি রপ্তানি করে। এমজিআই এ বছর দুটি চালান যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করেছে। সরাসরি রপ্তানি ছাড়াও বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজের রসদ সরবরাহের মাধ্যমেও পানি রপ্তানি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জাহাজের রসদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার থেকে বোতলজাত পানি নিয়ে তা জাহাজের নাবিকদের সরবরাহ করে।
তবে বোতলজাত পানি উৎপাদনে যা খরচ হয়, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় পরিবহন সরবরাহ ব্যবস্থায়। এ কারণে পানির রপ্তানি নির্ভর করে মূলত জাহাজ ভাড়ার উপর। জাহাজ ভাড়া বাড়লে রপ্তানি কমে যায়, ভাড়া কমলে রপ্তানি বেড়ে যায়। এরপরও প্রাণ–আরএফএল গ্রুপ বোতল জাত পানি রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে একটি নব্যধনিক শ্রেণির আবির্ভাব হয়েছে। যাদের রয়েছে প্রচুর অর্থ। তারা আমদানিকৃত পানি ব্যবহার করে। যদিও দেশের কোম্পানিগুলোর পানির মান আন্তর্জাতিক মানের। তবু তাদের প্রচুর অর্থবিত্ত ও বিদেশ প্রীতির কারণে বিদেশি পানির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। তাই বিদেশি পানি আমদানির ক্ষেত্রে তারকা হোটেল ও বিদেশিদের পানির চাহিদা–নিশ্চিত হওয়া সাপেক্ষে পানি আমদানির শর্ত আরোপিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক ঝর্ণা। সঠিক উদ্যোগ, পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তা পেলে পার্বত্য অঞ্চলেও গড়ে উঠতে পারে ঝর্ণার প্রাকৃতিক সুপেয় পানির বোতলজাত করার কার্যক্রম। আর এই কার্যক্রমটি সঠিকভাবে করা গেলে দেশে আমদানির পরিবর্তে প্রাকৃতিক পানি রপ্তানিও করা যাবে। যাতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট