চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে দক্ষ জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে চসিকের সদ্য বিদায়ী প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে প্রায় ১০ হাজার লোক কাজ করে। তার মধ্যে এক হাজারও কাজের লোক নেই। নিয়োগে কোনো নিয়মেরবালাই নেই। দক্ষ জনবল তৈরি করতে না পারলে সংকট থেকে যাবে। যিনি যে কাজের লোক, তাকে সেই জায়গায় বসাতে হবে। পরিচ্ছন্ন বিভাগে কিছু অতিরিক্ত লোক আছে। অতিরিক্ত জনবল ছাটাই করা উচিত। মেকানিক্যাল ও বিদ্যুৎ বিভাগ আকারে বিরাট, কিন্তু সেখানে একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারও নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর জামালখানে সিনিয়রস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সদ্য বিদায়ী প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন এসব কথা বলেন।
উল্লেখ্য, গত বছর ৬ আগস্ট থেকে ১৮০ দিন (৬মাস) দায়িত্ব পালন শেষে গত ১ ফেব্রুয়ারি চসিকের প্রশাসক পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর ছয়মাসের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গতকাল তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। চসিকের দুুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে নব নির্বাচিত মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে সদ্য বিদায়ী প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে ‘চোখ-কান খোলা রাখতে হবে’। কর্পোরেশনের প্রত্যেকটি বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে। দুর্নীতি সারা বাংলাদেশে যেটা আছে, সেটা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনেও আছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তো আর বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়; কিন্তু মেয়র যদি সজাগ থাকেন, চোখ-কান খোলা রাখেন এবং দুর্নীতিবাজ হিসেবে যারা পরিচিত তাদের যদি আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেন, তাহলে দুর্নীতি নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছে, তাদের সরিয়ে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
হোল্ডিং ট্যাঙকে অটোমেশনে আনার পরামর্শ দিয়ে সদ্য বিদায়ী প্রশাসক সুজন বলেন, ট্যাঙ আদায় পদ্ধতিকে সহজ করতে হবে। হোল্ডিং ট্যাঙকে যদি অটোমেশনে আনা যায় তাহলে ট্যাঙ আদায় বাড়বে। আমাদের চট্টগ্রামের লোকজন লাইন ধরে টাকা দিতে চায় না।
চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থানের যারা সুবিধাভোগী তাদের থেকে সার্ভিস চার্জ আদায় করতে হবে। সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী চট্টগ্রাম বন্দর। পাঁচ টন গাড়ি চলার উপযোগী রাস্তায় চট্টগ্রাম বন্দরের ২০-৩০ টন ওজনের গাড়ি চলছে। তাদের ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। কেন তারা দেবে না ? নতুন এসেসমেন্টে ২১৬ কোটি টাকা হয়, এখন দেয় ৩৬ কোটি টাকা। ১ শতাংশ দিলে ৭০০ কোটি টাকা আসবে।’
কাস্টমস আয় করেছে একবছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকেও ১ শতাংশ দিতে হবে। আমি যখন এই কথা বলেছি তখন নীতিনির্ধারকরা আমাকে বললেন-এটা বলবেন না। কেন বলব না? ল্যান্ড অব অরিজিন চট্টগ্রাম। কর্পোরেশনকে দেওয়া মানে চট্টগ্রামকে দেওয়া। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে বাংলাদেশের উন্নতি হবে। দুই ইপিজেডে মিলে ১৪০০ প্রতিষ্ঠান আছে, এরমধ্যে মাত্র ১২ টার ট্রেড লাইসেন্স আছে। দুই ইপিজেডের ১০-১৫ লাখ লোক এ শহরকে ব্যবহার করছে। আমি বেপজার চেয়ারম্যানের সাথে বসেছিলাম। তিনি বললেন সরকারের সাথে ইপিজেডের এই ধরনের চুক্তি আছে। ট্যাঙ না দিক সার্ভিস চার্জ কেন দেবেন না? ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কি ভাবে ব্যবসা করা যায় ? দুবাই, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর গেলে কি ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করতে পারবে?
নতুন মেয়রকে ‘নগরপিতা’ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘নতুন মেয়রের প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে-উনাকে নগরপিতা হতে হবে। প্রকৃত অর্থেই নগরপিতা হয়ে উনাকে সব মানুষের হতে হবে।’
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে দিনের ১২টায়ও অফিসে আসে না। অনেকে আবার রাত ২টায়ও লাইট জ্বালিয়ে কাজ করে। এটা কেন হবে? আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সোয়া ৯টায় কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দিয়েছি। এরপর অনেকে এসে ঢুকতে পারেনি।’
শিক্ষাখাতে অতিরিক্ত জনবলের কথা উল্লেখ করে সুজন বলেন, অতিরিক্ত জনবলের কারণে শিক্ষা খাত এখন চসিকের জন্য বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষাখাতে অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। চসিকের একজন শিক্ষক (ষষ্ঠ গ্রেডের) বাইরের শিক্ষকের চেয়েও ২৫ হাজার টাকা বেশি বেতন পান। মাসে তিন কোটি আর বছরে ৩৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ একটা আছে, সেখানে ৭০ জন ছাত্র ৩৫ জন শিক্ষক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।
চসিকের নগর পরিকল্পনা বিভাগের কোনো কাজ নেই উল্লেখ করে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, প্ল্যানিং বিভাগের কাজ শুধু গাছের চারা লাগানো। সৌন্দর্য বর্ধন করা। সেখানে পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ দিয়ে সেটাকে নতুনভাবে সাজাতে হবে।
অতিরিক্ত জনবল ছাটাই করা উচিত বলে জানান, খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, পরিচ্ছন্ন বিভাগে অতিরিক্ত লোক ঢুকে গেছে। কর্পোরেশনে এখন মাসে খরচ ১৮ কোটি টাকা। আগামী মার্চ থেকে সেটা ১৯ কোটি টাকা হবে। গ্যাস-জ্বালানি তেল এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা তৈরি করতে পারলে সাশ্রয় হবে।
পণ্যবাহী বড় যানবাহন থেকেও চার্জ আদায়ের পক্ষে মত দিয়ে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, কন্টেনার ইয়ার্ডগুলো শহরের গলার কাঁটা হয়ে আছে। হাজার হাজার ট্রেলার চলছে। কাঠগড় থেকে পতেঙ্গা সব কন্টেনার ইয়ার্ড। তারা ডলারে চার্জ নেয়। আমাদের চার্জ দিতে হবে। এতে করে বছরে দুই তিন হাজার কোটি টাকা আয় হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নিজেও চলতে পারবে, আশেপাশের কয়েকটি পৌরসভাও চালাতে পারবে।