সুগন্ধা ও ধলেশ্বরী নদীর বুকে কান্নার কলরোল

অনুপ দাশ গুপ্ত | মঙ্গলবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

উন্নয়নের পাহাড় চূড়ায় বসে ছোট ছোট মানুষের কান্নার সুতীব্র ধ্বনি রাজা-মহারাজাদের কর্ণ কুহরে না পৌঁছাই স্বাভাবিক। নিখোঁজ গণতন্ত্রের এ দেশে পানির উপর আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায় মানুষ, নদীর বুক চিরে পোড়া লাশের গন্ধ ভেসে আসে, মানুষ নদীর স্রোতে নিখোঁজ হয়ে যায়, সহস্র মানুষের আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী, কিন্তু আমরা জীবিতরা নির্বিকার। এত বিষাদ, বিপদ-বিপত্তির মধ্যেও উন্নয়ন হচ্ছে। প্রবল প্রতাপে তা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সে উন্নয়ন-উন্নতি বিবেকের নয়, সংবেদনশীলতার নয়, মনুষ্যত্বের নয়।এটা হচ্ছে লাভ ও লোভের উন্নতি এবং যন্ত্র দানবের উন্নতি। আগুন নেভাতে পানি লাগে অথচ ওই পানির উপরই আগুন জ্বলে। আগুন নেবে না বরং আগুন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। আগুন থেকে বাঁচতে মানুষ পানিতে পড়ে আবার পানিতে নিখোঁজ হয়ে যায়। গত ২৪ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) গভীর রাতটা কেমন ছিল? জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে স্বজন-প্রিয়জন খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা, আগুনে ভস্ম হয়ে যাবার যন্ত্রণা কেমন হয়, শুধু তাঁরাই বলতে পারেন যারা হারিয়েছেন তাদের প্রিয়জনকে। সুগন্ধার বুকে পুড়ে ভস্ম হওয়া ও ধলেশ্বরীতে নিঁখোজ হওয়া মানুষের স্বজনদের আর্তনাদের চিত্র দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে গেল ফ্রান্সের নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত সাহিত্যিক পাত্রিক মোদিয়ানোর লেখা ‘মিসিং পারসন’ বা ‘নিখোঁজ মানুষ’ উপন্যাসের কথা, যেখানে দেখানো হয়েছে :-‘একজন গোয়ান্দা বা ডিটেকটিভের কাজ হলো স্মৃতি ভ্রষ্ট মানুষ তিনি কে ও সন্ত্রাসবাদীদের হাতে গুম হয়ে যাওয়া নিখোঁজ মানুষের সন্ধান করে বের করা, কিন্তু খুঁজে না পাওয়া এবং এসব অপরাধে দোষীদের শাস্তি না হওয়ায় আদালতের বিষন্ন বিচারক ও বিচারালয়, নীরব ও সংবেদনহীন নির্বোধ জনগণের বিবেককে দায়ী করে রায় দেয়ার কথা’। সুগন্ধা নদীর বুক চিরে কান্নার শব্দ থামতে না থামতেই গত ৫ জানুয়ারী (বুধবার) নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ধলেশ্বরী নদীতে ঘটে যায় আরও একটি দুর্ঘটনা, যেখানে লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায় যাত্রীবাহী একটি ট্রলার এবং ট্রলারে থাকা ৪০ জন যাত্রীর মধ্যে ৯ জন যাত্রী পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়ে যায় (আজকের পত্রিকা’০৬/০১/২২)। যাদের লাশ পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া যায় ধলেশ্বরী নদীর বুকে দূর-অদূরে বিভিন্ন স্থানে। এসব নির্মম ও হৃদয়বিদারক ঘটনা বন্ধের কোনো লক্ষণ লেশমাত্র পরিলক্ষিত নয়। আমরা ধরেই নিয়েছি এসব ঘটনা ঘটবে, মানুষ পানির উপর পুড়ে ভস্ম হবে, নদীর পানিতে ডুবে চোরা ও প্রবল স্রোতে নিখোঁজ হয়ে যাবে, কিছুক্ষণ কান্নার সুতীব্র শব্দ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হবে আবার তা কিছুদিন পর থেমে যাবে। আমরা আমজনতা সব ভুলে যাবো অসংখ্য নতুন নতুন দুর্বহ ঘটনার সুবিস্তৃত চাপে সেই নোবেল বিজয়ী কালজয়ী বিখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেসের লেখা ‘নি:সঙ্গতার একশত বছর’-উপন্যাসের মাকোন্দো গ্রামের অদ্ভুত ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত জনগণের মত এবং আশ্চর্য স্মৃতিহীনতার মহামারি জাদুবাস্তবতার গল্পের মত। এসব ঘটনায় আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, মানবিক সংবেদনশীলতা এখানে শূন্যের কোটায়। কী ভয়াবহ বৈরিতার বুক চিরে এখানে জীবন এগিয়ে চলে! ষাটের দশকে আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনে হৃদয় স্পর্শ করা ছবি ‘এতটুকু আশা’য় প্রয়াত শিল্পী আবদুল জাব্বারের কণ্ঠে গীত-‘তুমি কি দেখছ কভু/জীবনের পরাজয়/দু:খের দহনে করুণ রোদনে/ তিলে তিলে তার ক্ষয়……..’ শ্রোতাপ্রিয় এই গানের স্বরলিপি যেন নিখোঁজ ও ছাই ভস্ম হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য। পুড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও তাদের জীবনে কত কত স্বপ্ন ছিল, কত কত আনন্দের গল্পছিল! এখন সব ছাই ভস্ম। এ প্রসঙ্গে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামশুল হকের লেখা গল্প গ্রন্থ ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’-এর কথা মনে পড়ে ,এই গ্রন্থের একটি গল্প ‘যদি গাবতলীতে দেখা হতো’- যেখানে গল্পের নায়ক নিখোঁজ হয়ে যায় ফেরিডুবিতে, তাঁর আর কোনোদিন আসা হয়নি প্রিয় মেয়েটির কাছে আদরের বাবা হয়ে, ফিরে আসা হয় নি প্রিয়তমা স্ত্রী’র কাছে, যারা বাবা ও স্বামী আসার অপেক্ষায় ছিল গাবতলীর ঘাটে। এরকম শত শত নিখোঁজ ও পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া মানুষের করুণ রোদনের গল্প সুগন্ধা, ধলেশ্বরী ও আগুন মুখার মত অনেক নদীর বুকে গুমরে গুমরে কাঁদছে।
১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত নৌ দুর্ঘটনার জন্য দেশে পাঁচ শতাধিক মামলা চলছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র একটির বেশি মামলার বিচার এখানো পর্যন্ত শেষ হয়েছে বলে জানা যায়নি ( প্র: আলো’ ২৯/১২/২১)। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে পানির ওপর আগুনে পুড়েছে মানুষ। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বাংলাদেশের সুগন্ধা নদীর বুকে লঞ্চে পুড়ে যাওয়া মানুষের এই দুর্ঘটনার খবরের শিনোনাম করেছে ‘জতুগৃহ লঞ্চ, ৪২ জনের মৃত্যু’।
মহাভারতের একটি বর্ণনায় পড়েছি,-“পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য দুর্যোধনদের নির্দেশে স্থপিত পুরোচন বারণাবত নামক এক মনকাডা জায়গায় সুশোভন প্রাসাদ ‘জতুগৃহ’ নির্মাণের কথা। কথাছিল সেখানে কুন্তীসহ পাণ্ডবরা বিশ্রাম নেবেন, ছুটি কাটাবেন। বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ যেমন ঘি, লাক্ষা, মোম ইত্যাদি দিয়ে তৈরী জতুগৃহে তখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে। বলাবাহুল্য, মহাভারতের পাণ্ডবরা সব সংকট অবলীলায় কাটিয়ে ওঠেন। তাঁরা কৌশলে আগুন তথা জতুগৃহ থেকে রক্ষা পান এবং নৌকোয় করে নদী পার হয়ে জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে সক্ষম হন। কোন দেবদূত তাঁদের নৌকার ব্যবস্থা করে থাকবেন হয়তো’। কিন্তু কী অদ্ভুত মিল পৌরাণিক সেই কাহিনির সাথে সুগন্ধা নদীর ঘটনার! সুগন্ধায় ভাসমান জতুগৃহ থেকে প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া যাত্রীদের উদ্ধার করতে এক অলৌকিক নৌকা চলে আসে অন্ধকার ফুঁড়ে। যন্ত্রের নৌকা ট্রলার নিয়ে চলে আসেন মাঝি মিলন খান (প্র:আলো’ ২৯/১২/২১)। তারপরও ভস্ম হয়ে যাওয়া ও নদীর হিম শীতল পানিতে মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারে নি। পুড়ে কয়লা হওয়া প্রায় ৫০টি লাশ মাটিচাপা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার মাথা তুলবে উটের মাথার মতো উঁচু উন্নয়ন ও মালিকদের লঞ্চ ব্যবসার লাভের কারবার। শান্ত সুগন্ধা নদীর বুক চিরে বরগুনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লঞ্চ এম ভি অভিযান-১০। শীতের হিমেল হাওয়া ঠেকাতে লঞ্চের চারপাশ ঘিরে শক্ত করে ত্রিপল বাঁধা। হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণে জেগে ওঠে সবাই। ছড়িয়ে পড়ে আগুন। জীবন বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক ঘণ্টা আগুন জ্বলার পর পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিস। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে আরও দেড় ঘণ্টা পর। ততক্ষণে শান্ত সুগন্ধা জুড়ে কেবলই পোড়া লাশের গন্ধ। এই ঘটনায় আরও স্পষ্ট হলো, এ দেশের নৌপরিবহন ব্যবস্থায় যাত্রীদের সুরক্ষা- ব্যবস্থা কত দুর্বল ও ঠুনকো ! লঞ্চে আগুন লাগার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনের কারণ নাকি ইঞ্জিন রুম। আমার জানামতে, বেশির ভাগ লঞ্চে পর্যাপ্ত বয়া, লাইফ জ্যাকেট, আগুন নেভানোর সরঞ্জাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। লঞ্চে আগুন লাগতেই পারে বা কোনো ধরনের সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু বিপদে পড়লে যাত্রীরা কীভাবে লঞ্চ থেকে বের হবেন, তাঁদের জীবন কীভাবে রক্ষা করবেন, সেটার কোনো ব্যবস্থা থাকে না যাত্রীবাহী লঞ্চে। এসব যাত্রীবাহী বাহনে যদি পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট থাকত, সেটা পরে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ভেসে থাকতে পারত মানুষ। তাতে এত মানুষের প্রাণহানি হতো না। দেশের লঞ্চগুলোয় এখন যাত্রীদের সুরক্ষার বিষয়ে ভাববার সময় এসেছে। আমাদের দেশে চলমান লঞ্চ গুলোর মধ্যে যাত্রীদের সুরক্ষার বিষয়গুলো এখনও অনিশ্চিত। যার ফলে এধরনের ঘটনা ঘটছে, প্রাণ যাচ্ছে মানুষের অকাতরে। ভবিষ্যতে লঞ্চে আগুন লাগলে লঞ্চের মধ্যেই সেই আগুন যেন নেভানো যায়, সেজন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা রাখতে হবে। লঞ্চের নকশা তৈরীর দিকেও নজর দেওয়া উচিত। দুর্ঘটনা এড়াতে লঞ্চের কোনো কারিগরি ত্রুটি আছে কিনা, তা নিয়মিত দেখভাল করা উচিত। আমার তো সন্দেহ হয় এই লঞ্চের আদৌও ফিটনেস ছিল কিনা! নৌপরিবহন সেক্টরে নিয়মিত লঞ্চের ফিটনেস নবায়ন করে কিনা তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ? আমার জানা মতে এগুলো নিয়মিত হয় না।এসব বিষয়ে শৃঙ্খলা না আনতে পারলে এরকম মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা আরো ঘটতে থাকবে। তাই নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি সব বিষয়ে নজর দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে, তত তাড়াতাড়ি এসব দুর্ঘটনা বন্ধ হবে। এছাড়াও এই ঘটনায় দায়ী লঞ্চমালিকদের শাস্তির আয়তায় আনাও নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে গত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৪৮৬টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে (বাংলা: প্রতিদিন’ ২৬/১২/২১)। গণতন্ত্র ভিআইপি তন্ত্রে অধঃপতিত হয়েছে। জনগণ করোনা আক্রান্ত হয়ে মরবে, অ-করোনা রোগে চিকিৎসা না পেয়ে মরবে, জেল খেটে মরবে, চাকুরি হারিয়ে মরবে বা ডিজিটাল বাক-পরাধীনতায় মরবে, অপুষ্টিতে মরবে,- যেভাবেই মরুক, মরতে তাকে হবেই। যদি নাই মরে, এই নির্লজ্জ মনুষ্যত্ববিহীন বেঁচে থাকাই এক গোটা প্রজন্মকে চির অপরাধী করে রাখবে। ঘরে ঘরে প্রিয়জনের মৃত্যুর শোক-বিলাপের মধ্যে অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে এক মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণায় মরমে মরে বেঁচে থাকবে এরা। নিজের চোখের দিকে তাকাতে না পেরে মাথা নিচু করে বেঁচে থাকার এক বিষম লজ্জা টুটি চেপে ধরবে ! লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবছায়া
পরবর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ের ১০৮তম দিবস ও আমাদের করণীয়