সুখের সংসারে অন্ধকার

করোনায় যেভাবে বিপর্যয় নেমে আসে একেকটি পরিবারে ।। সঙ্কটে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

ষাটোর্ধ্ব রাবেয়া বেগম চার সন্তানের জননী। দুই সন্তান থাকেন সৌদি আরবে। অপর দুজন গ্রামে চাষাবাদ করেন। পরিবারে তেমন কোনো সংকট ছিল না। সন্তানদের নিয়ে সুখেই ছিলেন তিনি। কিন্তু রাবেয়ার সংসারে হঠাৎ নেমে আসে অন্ধকার। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল, এক ওষুধের দোকান থেকে আরেক ওষুধের দোকানে স্বজনদের ছোটাছুটি। ছোটাছুটির কারণ রাবেয়ার করোনা পজিটিভ হয়েছে। নগরীর মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাবেয়া বেগম। ২৪ ঘণ্টায় অক্সিজেন মাস্ক মুখে নিয়ে সময় কাটছে তার। প্রতি ঘণ্টায় ৩৮০ টাকা করে দৈনিক ৯ হাজার টাকা খরচ হয় অক্সিজেনের পেছনে। এর বাইরে রয়েছে ডাক্তার ও ওষুধ খরচ। সব মিলিয়ে দৈনিক খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকা। রাবেয়া বেগমের ছেলে ওসমান গত শনিবার দুপুরে আজাদীকে বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি জানান, করোনা থেকে সেরে উঠতে প্রয়োজন ৯ হাজার টাকা মূল্যের একটি বিশেষ ইনজেকশন। এ রকম ১০টি ইনজেকশন মাকে দিতে হবে। এটি দেওয়া শুরু হলে দৈনিক খরচ আরও বাড়বে।
রাবেয়ার বাড়ি ফটিকছড়ি। নগরীর পলিটেকনিক এলাকায় ভাইয়ের বাসা। শনিবার তার পাশে ছিলেন ভাইয়ের দুই ছেলে। এদের একজন নজরুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, ফুফু এক সপ্তাহ ধরে মেডিকেল সেন্টারে আছেন। এখানে তার করোনার চিকিৎসা হচ্ছে। দৈনিক অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এর মাঝে আইসিইউতে স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।
মেডিকেল সেন্টারের আইসিইউতে দৈনিক ৩৫ হাজার টাকা গুনতে হবে উল্লেখ করে নজরুল বলেন, এত টাকা দিয়ে আইসিইউতে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব না। ইতোমধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। ফুফাত ভাইয়েরা বিদেশ থেকে কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছেন। এমন বিপর্যয় নেমে আসবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু বিপর্যয় ঠিকই নেমে এল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। অথচ ক’দিন আগেও সব ঠিকঠাক ছিল।
তিনি বলেন, আইসিইউতে স্থানান্তর করার বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরছি। জেনারেল হাসপাতাল থেকে শুরু করে মা ও শিশু হাসপাতাল সব জায়গায় যোগাযোগ করেছি। এমনকি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও যোগাযোগ করেছি। কোথাও আইসিইউ বেড খালি নেই।
রাবেয়ার সন্তান ওসমান বলেন, আমরা ভালোই ছিলাম। হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেল। মায়ের করোনা হওয়ায় আমাদের চোখে ঘুম নেই। আমরা দুই ভাই মায়ের দেখাশুনা করছি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই তা করছি। যদিও ডাক্তার-নার্সরাও আছেন, তারপরও ডাক্তার কখন কি বলেন, কোনো ওষুধের প্রয়োজন হচ্ছে কিনা, এসবের জন্য প্রস্তুত থাকি। আর সৌদি আরবে ভাইয়েরা আছেন দুশ্চিন্তায়। তারা সারাক্ষণ মায়ের খোঁজখবর নিচ্ছেন।
শুধু রাবেয়া বেগম নন, নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের এমন অনেককে করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করতে দেখা গেছে। তাদের একজন হানিফ মিয়া (ছদ্মনাম)। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আজাদীকে বলেন, তার বাবা করোনার সাথে যুদ্ধ করছেন এক মাস ধরে। তার সাথে আমরা পরিবারের সদস্যরাও যুদ্ধে নেমে পড়েছি। তবে তিনি এখন প্রায় সুস্থ।
মেডিকেল সেন্টারে তার বাবা চিকিৎসা নিচ্ছেন উল্লেখ করে হানিফ বলেন, আমাদের পরিবার নিম্নবিত্ত। তবে অবস্থা তেমন খারাপ না। কিন্তু বাবার করোনা ধরা পড়ার পর অবস্থা খুব খারাপ। এ পর্যন্ত অনেক টাকা খরচ করেছি। তিন দিনে ৯৮ হাজার, সাত দিনে ৯৫ হাজার টাকা খরচ করার রেকর্ড আছে। জেনারেল হাসপাতালে হাইফ্লো নেজাল ক্যানুলা সেবা ফ্রিতে পাওয়ায় খরচ অনেকটা কমে গেছে। হাইফ্লো নেজালে অনেক টাকা খরচ হয়। তিনি বলেন, এটি কোনো একক যুদ্ধ না, সামগ্রিক যুদ্ধ। পরিবারের কেউ আক্রান্ত হওয়া মানে সবাই আক্রান্ত হওয়া। স্বাভাবিক সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। গত মাস এভাবেই কেটেছে।
শুধু হানিফ কিংবা ওসমান নন, হাসপাতাল এলাকা ঘুরে দেখলে এমন অনেকেরই দেখা মিলবে। তাদের সাথে কথা বললে বোঝা যাবে করোনা একেকটা পরিবারের ওপর কেমন বোঝা চাপিয়ে দেয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-অন্ত্যমিল