পানি নেই এমন একটি অজুহাতে গত ৩০ বছর ধরে ঝুলে থাকা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পের ভাগ্য ফিরতে যাচ্ছে। আবাসিক এলাকার ৫১৯ টি প্লটে পানি সরবরাহ সুবিধা দেয়ার ব্যাপারটি নিয়ে আজ সিডিএ এবং ওয়াসার মাঝে একটি অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হতে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিডিএ আবাসিক এলাকা বাস্তবায়ন করলেও শুধুমাত্র পানির অভাবে একটি প্লটও বাসযোগ্য হয়নি গত ৩০ বছরে।
শহরের কোল ঘেঁষা কর্ণফুলী নদীর বাম তীরে গড়ে উঠা আবাসিক এলাকাটিকে একটি মনোরম এবং বাসযোগ্য আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ থাকলেও তা হয়ে উঠেনি। ওয়াসার ভান্ডালজুরি প্রকল্প থেকে ওই এলাকায় পানি সরবরাহ দেয়া হলেও পাইপ লাইন নির্মাণের দশ কোটি টাকার খরচ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় বিশাল আবাসিক এলাকাটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। আজ অনুষ্ঠাতব্য সিডিএ’র বোর্ড সভায় বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে কর্ণফুলী আবাসিক প্রকল্পে পানি সরবরাহ দেয়ার বিষয়টির সুরাহা হতে পারে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সূত্র জানায়, আবাসন সংকট ঘুচানোর পাশাপাশি নগরীর ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে সিডিএ কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্জ্যারটেকে কর্ণফুলী আবাসিক এলাকা প্রকল্পটি গ্রহণ করে। ৫১.৬৭ একর জায়গার উন্নয়ন শেষে সিডিএ ৫১৯টি প্লট, রাস্তাঘাট এবং ড্রেনসহ বিভিন্ন সুবিধা তৈরি করে প্লট বরাদ্দ দেয়। প্রকল্পটির প্রজেক্ট প্রোফাইলে আবাসিক এলাকাটিতে প্রয়োজনীয় নালা–নর্দমা, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, কবরস্থান, মার্কেট, নিরাপত্তা বেষ্টনী, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার সুপেয় পানি সরবরাহ করাসহ যাবতীয় সুযোগ–সুবিধা প্রদান করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। সিডিএ কোটি কোটি টাকা খরচ করে সবকিছুই করেছে। শুধু পানির সংস্থান না হওয়ায় সব আয়োজনই মাঠে মারা পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
সূত্র বলেছে, এলাকাটিতে যে পানি নেই সেটা সিডিএ আগে জানতো না। এই ব্যাপারে কোন পরীক্ষা–নিরীক্ষাও করা হয়নি। আবাসিক এলাকাটি পুরোপুরি প্রস্তুত করার পর দেখা যায় যে, এলাকায় সুপেয় পানির কোন সংস্থানই নেই। টিউবওয়েল বসিয়েও পানির কোন সংস্থান হয়নি। হাজার ফুট নিচের পানিও লবণাক্ত। এতে করে ৫১৯টি প্লটের একটিতেও কোন ধরনের বাড়ি ঘর বা ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়নি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্লট বরাদ্দ নেয়া মানুষগুলোর নিজের বাড়ি করার স্বপ্ন শুধুমাত্র পানির অভাবেই ভেস্তে যায়। আবাসিক এলাকাটির প্লট বরাদ্দ গ্রহীতারা একটি সমিতি গঠন করে পানির জন্য ওয়াসার দুয়ারে ধর্ণা দিতে থাকে। কিন্তু দিনের পর দিন যায়, মাসের পর মাস যায় পানির সংস্থান হয় না। এভাবে ইতোমধ্যে চলে গেছে ত্রিশ বছর। পানির দেখা না পাওয়ায় ৩০ বছর ধরে ৫১৯ জন প্লট গ্রহীতা চরম এক অনিশ্চয়তায় সময় কাটাতে থাকেন। নিজের বাড়ি করার স্বপ্নতো দূরের কথা, নিজের জায়গায় গিয়ে একটু অবসর কাটাতেও পারেন নি কেউ। পুরো এলাকাটি জঙ্গলে পরিণত হয়ে সাপের বাসা হয়ে ওঠে। রাতে এলাকাটি ভুতুড়ে পরিবেশ লাভ করে। অনেকেই জীবনের মূল্যবান উপার্জন দিয়ে, অনেকেই গ্রামের জমি জমা বিক্রি করে আবাসিক এলাকার প্লট কিনেছেন। কিন্তু প্লট কিনে ভয়াবহ এক দুর্দশার কবলে পড়েন তারা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন প্লট গ্রহীতা মারাও গেছেন। যারা নিজের প্লটে একটি বাড়ি করার অপূর্ণ বাসনা নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন।
প্লট মালিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বর্তমান চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নুরুল করিম ব্যক্তিগতভাবে কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহ দেয়ার অনুরোধ করে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে সিডিএ চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন যে, কর্ণফুলী নদীর বামতীরের এলাকা সমূহে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা ‘ভান্ডালজুরি’ পানি শোধণাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদীর বামতীরে শিকলবাহা, চর পাথরঘাটা, রাঙ্গাদিয়া, বড় উঠান, চরলক্ষ্যা ২৯০০ একর বিশিষ্ট কোরিয়ান ইপিজেড, ২টি বৃহত্তম সার কারখানা, কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি (এস.আলম সিমেন্ট), স্টীল মিল এবং ১০ মেগাওয়াট বিশিষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মিল, শিল্প কারখানা ও তার আশে–পাশের জনবসতি এলাকায় ওয়াসা পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু সিডিএ কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। চিঠিতে ভান্ডালজুরি প্রকল্পের আওতায় সিডিএ কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন সংযোগ স্থাপন করা জরুরি বলে উল্লেখ করে তিনি পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন।
এর আগে চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহ দিতে হলে পাইপ নির্মাণে ১০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে উল্লেখ করে এই টাকা পরিশোধের জন্য সিডিএকে প্রস্তাব দেয়। অর্থাৎ সিডিএ যদি আবাসিক এলাকার ভিতরে পাইপ লাইন স্থাপনের ১০ কোটি টাকা খরচের যোগান দেয় তাহলে ওয়াসা পানি দেবে। কিন্তু ৩০ বছর আগে শেষ হওয়া একটি প্রকল্পে নতুন করে ১০ কোটি টাকা যোগান দেয়া সিডিএ’র পক্ষে কঠিন। এমতাবস্থায় পানি সরবরাহের ব্যাপারটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নুরুল করিম গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিষয়টিকে খুবই সিরিয়াসলি দেখছি। এতোগুলো মানুষ শুধু পানির অভাবে কষ্ট করছেন, বিষয়টি দুঃখজনক। তাই আমি ওয়াসার বর্তমান এমডি সাহেবকে বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার অনুরোধ করেছি। ওয়াসার বর্তমান এমডি, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার পাশা বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়েই ভাবছেন।
সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ওয়াসার এমডি সিডিএ বোর্ডের সদস্য। তিনি আজ (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠাতব্য বোর্ড সভায় আসবেন। আমরা বোর্ড সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে একটি সুরাহায় আসার চেষ্টা করবো। সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ১০ কোটি টাকার বিষয়টি পুর্নবিবেচনা করে কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলে আমরা ওই টাকা সিডিএ থেকে যোগান দিয়ে ৫১৯টি প্লট মালিককে উদ্ধার করার চেষ্টা করবো।
কর্ণফুলী আবাসিক প্লট মালিক সমিতির সহ–সভাপতি অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের শেষরক্ষা হয়। প্লট কেনার পর ৩০টি বছর পার হয়ে গেছে। আমরা ভয়ংকর এক মানসিক যন্ত্রণার মাঝে দিন পার করছি। একটি শহরে শুধু পানির অভাবে একটি আবাসিক এলাকা পরিত্যক্ত হয়ে যাবে সেটি মেনে নেয়া যায় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।