‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।’- জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আক্ষেপ আমাদের গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে। এক জীবনে বিশাল বিশ্বের অনেক কিছু দেখতে না পারার ব্যর্থতা কবিগুরু পুষিয়েছেন গ্রন্থের মাধ্যমে। তিনি লিখেছেন- ‘সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে/ অক্ষয় উৎসাহে-’। কবিগুরুর নির্দেশিত পথে তাই আমাদেরও পথচলা। অজানাকে জানার আর অদেখাকে দেখার মোক্ষম মাধ্যম ভ্রমণ বৃত্তান্ত। আর সেই বৃত্তান্ত যদি হয় সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ, তাহলে তো কথাই নেই। ষাট ও সত্তর দশকের তুখোড় ছড়াকার, শিশু সাহিত্যিক শৈবাল বড়ুয়ার ‘ভ্রমণে মেলবন্ধন’ সে রকমই একটি গ্রন্থ।
শৈবাল বড়ুয়া কর্মসূত্রে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন এবং তাঁর দেখা ও জানার কথাগুলো আমাদের না জানিয়ে পারেননি। ফলে আমরা পেয়েছি এক চমৎকার সুখপাঠ্য ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বইতে দশটি অধ্যায় রয়েছে। সর্বোচ্চ তিনটি অধ্যায় রয়েছে থাইল্যান্ড ভ্রমণের উপর। অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ নিয়ে দু’টি এবং চীন, সিঙ্গাপুর, হংকং, নেপাল, ভারত ভ্রমণ নিয়ে একটি করে অধ্যায় রয়েছে এই বইতে। অধ্যায়গুলোর নামকরণে তাঁর কাব্য প্রতিভার পরিচয় মেলে। সিডনির সীমানায়, মেলবোর্নের মেলবন্ধন, কেন্টনের লণ্ঠন, সিঙ্গাপুরের সিংহদুয়ার, ব্যাংককে টক নেই, হংকংয়ের কুংফু, কাঠমান্ডুর কাঠাবনে- এই শিরোনামগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনুপ্রাস মনে করিয়ে দেয় শৈবাল বড়ুয়া ছন্দ-অন্ত্যমিলের একজন দক্ষ শিল্পী।
বইয়ের দশটি অধ্যায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে ‘সিডনির সীমানায়’। প্রায় ঊনাশি পৃষ্ঠার ভ্রমণ বিবরণের মধ্যে তিরিশ পৃষ্ঠা জুড়ে আছে সিডনির বয়ান। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। শৈবাল বড়ুয়া ও সুপর্না বড়ুয়ার কৃতী কন্যা দেবযানী স্বামী ও কন্যাকে নিয়ে থাকে সিডনিতে। তাই সেখানে চারমাস অবস্থান। এই চারমাসে সিডনির চারদিকে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শুধু ভ্রমণের বিবরণ নয়, এই গ্রন্থের বড় প্রাপ্তি হলো, তিনি যেখানেই গেছেন, সেখানকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলো পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। অনায়াস বিবরণে উঠে এসেছে প্রবাসে থাকা মানুষগুলোর অন্তরঙ্গ জীবন। শুধু বাঙালি নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশের, এমন কি আফ্রিকা ইউরোপের মানুষদের দিনযাপনের গল্প। অস্ট্রেলিয়ার জনমানুষ, এমনকি আদিবাসীদের ইতিহাসও বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে। নানা দেশে ভ্রমণ করতে গিয়ে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন নানান দেশের নানান সংস্কৃতির মেলবন্ধন। ভ্রমণ আনন্দদানের পাশাপাশি নিজেকে বিশ্বমানবের অংশ হতে শেখায়, যা জীবনে অপরিহার্য।
সিডনি ভ্রমণে লেখকের সঙ্গে আমরাও আবিষ্কার করলাম ক্যাম্পাসি এলাকার মার্কেটে চকবাজার, গুলিস্তান, মধুমেলা, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল ইত্যাদি ঢাকাই নামের দোকান। সুপার স্টোরগুলোতে গার্মেন্টস বিভাগে বাংলাদেশে তৈরি, জিন্সপ্যান্ট, ব্লেজার, ভেনিম দেখে যে লেখকের মন গর্বে ভরে ওঠে, পড়তে পড়তে তা আমাদেরও দোলা দেয়। ইয়ারা নদীর দুই তীরে কিছু লোক বসতি গড়েছিলো উনিশ শতকের শুরুতে। সেই ক্ষুদ্র লোকালয় আজ আধুনিক মেলবোর্ন। মেলবোর্নের মেলবন্ধন আমাদের আকর্ষিত করে।
চীনের দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায় অবস্থিত গোয়াংডং প্রদেশের রাজধানীর প্রাচীন নাম যে কেন্টন, সে কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। লেখক তাঁর চমৎকার বর্ণনায় তা মনে করিয়ে দিলেন। তাছাড়া সিঙ্গাপুর, শ্যামদেশ (থাইল্যান্ড), সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৪৩০ ফুট উপরে অবস্থিত কাঠমান্ডুর রমনীয় বিবরণী আমাদের ভালো লাগাকে ছুঁয়ে যায়। জয়পুর-আগ্রা-দিল্লি তো বলতে গেলে পাশের বাড়ি। কিন্তু সেই পাশের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সরল বর্ণনাও আমাদের ভালো লাগে।
নিজের ভ্রমণের জ্ঞান ও আনন্দ অন্যের মনে ছড়িয়ে দেয়াই লেখকের কাজ, আর সেই কাজে শৈবাল বড়ুয়া যে সম্পূর্ণ সার্থক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বইটিতে ব্যবহৃত ছবিগুলোও পাঠকের কিছুটা তৃষ্ণা মেটাবে।
এই সুখপাঠ্য ভ্রমণ কাহিনির সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন সদ্য প্রয়াত প্রিয় শিল্পী কবি খালিদ আহসান। ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রকাশক সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা খড়িমাটি। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্ত্রী এবং কন্যাকে, যারা শৈবাল বড়ুয়ার লেখক সত্তাকে সবসময় উৎসাহিত করেছে। বইটির মুদ্রণ ও বাঁধাই চমৎকার। উন্নত বাঁধাই বইয়ের মান যে বৃদ্ধি করে, এটি তার উদাহরণ।
শৈবাল বড়ুয়ার প্রথম গ্রন্থ কিশোর গল্পের বই ‘পলাশ ফোটার দিন’। ‘ভ্রমণ মেলবন্ধন’ তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ। আমরা অপেক্ষায় রইলাম তাঁর ছড়া ও কাব্যগ্রন্থের জন্য।