ইসমাইল জসীম। দেশের নিবেদিতপ্রাণ শিশুসাহিত্যিক। ছড়া, কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধসহ সাহিত্যের সব শাখায় সমান বিচরণ হলেও কিশোরকবিতা চর্চায় তিনি অধিক মনোযোগী। মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি ও কিশোর জগৎ তাঁর কবিতার উপজীব্য বিষয়।
বাল্যকাল থেকে কৈশোরকাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময় পরিধিতে একজন মানুষের স্বাভাবিক অস্বাভাবিক কিছু ভাবনা–কল্পনা, জগৎ পরিপার্শ্ব সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণজাত চেতনা অবচেতনের বিবরণ থাকে। এসবকে কবি যখন ধারণ করেন ও তাঁর স্বীয় অভিজ্ঞতার মিশেলে চমৎকার বিবরণকে কাব্যশক্তিতে রূপান্তরিত করে শিল্পিত বিন্যাসে অক্ষরবন্দি করেন, তখনই আমরা পাই তাঁর শক্তির পরিচয়। ইসমাইল জসীম ছড়া–কবিতায় তেমনিভাবে শিশু–কিশোরের মনোজগৎকে রাঙানোর প্রচেষ্টায় অবিরাম শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।
ইসমাইল জসীমের লেখালেখির শুরু আশির দশকের শেষের দিকে। প্রথম ছড়া–কবিতার বই ‘খুকুর নাচন দেখে যা’ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। তাঁর ‘ কিশোর ও মেঘবালিকা‘ কিশোর কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি চট্টগ্রাম একাডেমি প্রবর্তিত ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩ লাভ করেন। ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’ ইসমাইল জসীমের সপ্তম কিশোর কাব্যগ্রন্থ।
ইসমাইল জসীমের ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’ কবিতার বইটিতে কবির ১৯ টি কবিতা স্থান পেয়েছে। সব কবিতা মনকে স্পর্শ করে যাওয়া কবিতা। কবিতাগুলোতে দেশপ্রেম প্রকৃতি মুক্তিযুদ্ধ চিত্রিত হয়েছে কবির কলমের তুলির পরশে। একজন শিল্পী যেমন তাঁর ছবিকে তুলির পরশে জীবন্ত করে তোলেন তার স্বীয় দক্ষতা গুণে ঠিক তেমনি একজন কবিও তাঁর কবিত্বগুণে যেকোনো বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেন নিজস্ব বুননশৈলীতে। কবি ইসমাইল জসীম তেমন একজন কবি যিনি তাঁর কবিত্ব প্রতিভার নিগুঢ় স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি কবিতার চরণে চরণে। কিশোরকবিতা আমাদের শিশুসাহিত্যের এক চমৎকার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ‘ছুটে যায় মন মৃদু সমীরণ, জুড়ায় আমার বুক, /সবুজের সাথে চাই মিশে যেতে, আহা! কী দারুণ সুখ।’ ‘সবুজের সাথে মন মাতাতে’ বইয়ের নাম করণের সাথে এই শিরোনামের প্রথম কবিতাও প্রাণময় এক কিশোরকবিতা। ‘রাসেলের রক্তে আঁকা বাংলার মানচিত্র’ কবিতায় কয়েকটি চরণ এরকম– কেঁদে বললো রাসেল ‘মায়ের কাছে যাবো’/ কী ভয়ানক! দৃশ্য ছিলো একটু করে ভাবো।/ এক হায়েনা বললো ওঠে কে ওখানে আছে? বিচ্ছুটাকে পাঠিয়ে দাও ওর মায়েরই কাছে।’ রাসেলের হত্যাকাণ্ডের চিত্রকে কবি কী চমৎকার জীবন্ত করে তুলেছেন। মনে শিহরণ জাগায়, রাসেলের প্রতি এক নিবিড় ভালোবাসায় মন কেঁদে ওঠে। মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবার যে উক্তি রাসেল তা অনুভব করছে মমতায়, আর হায়েনারা বুঝিয়েছে মায়ের মৃত্যুর সাথে রাসেলকেও পাঠিয়ে দেবার একই ঠিকানায়। পাঠক মাত্রই কবিতাটি পড়ে পনেরই আগস্টের বিভীষিকাময় রাসেল হত্যাকাণ্ডকে উপলব্ধি করতে পারেন।
‘কোন পুকুরে ভাসছে জলে হরেক রকম হাঁসের ছানা/ কিচির মিচির করছে পাখি ভোরের আলোয় উড়িয়ে ডানা। দেখতো গাছের কোন ডালেতে ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা/ তাদের প্রতি সেই ছেলেটার ছিলো অগাধ ভালোবাসা।’ এই লাইনগুলো ‘শেখ মুজিবুর জাতির জনক’ নামক কবিতা থেকে নেয়া। কবি জাতির জনকের চরিত্রকে কী দারুণ কাব্যময়তায় উপস্থাপনা করেছেন। ‘মায়ের মুখের হাসি যেন জোছনা রাতের আলো। আলোয় ভরা তারার ভুবন দূর করে সব কালো।’ মায়ের হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ধরনের নিখাদ ভালোবাসা। চমৎকার উপমায় কবি পাঠকের কাছে তুলে দিয়েছেন অভিনব কবিত্বের ভাষায় মায়ের এ ভালোবাসা।
‘স্বপ্ন আমার’ কবিতায় কবি একটি লাইনে বলছেন ‘স্বপ্ন আমার ফেরি করে / প্রজাপতির ডানায় চড়ে।’ স্বপ্নকে তিনি প্রজাপতির ডানায় চড়িয়ে আমাদের পাঠকের মনকে ভাসিয়ে দিয়েছেন কল্পনার অবগাহনে। এটাই কবির বিশেষত্ব। ‘স্বাধীনতা চাই’ কবিতার শেষ দুটো চরণ, ‘আমরা বুঝি না এতো সব কিছু, আমরা কিশোর/, আমরা তো চাই শুধু স্বাধীনতা নির্মল আলোর ভোর।‘’ এই নির্মল আলোর ভোরই তো আমাদের শিশুকিশোরদের চাওয়া। এমন সুন্দর ভোরই তো আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। ‘ ‘আমি হবো ডানপিটে মেঘের বালক/ উড়াবো হাওয়ায় হাওয়ায় রঙিন পালক/ খেলবো রঙের খেলায় মেঘে আঙিনায়/ রঙধনু হয়ে রবো আকাশের গায়।’ একজন কিশোরের স্বপ্ন যে কী রোমান্টিকতায় বোনা হতে পারে কবিতাটি পড়েলই বুঝা যায়। ‘আমি মেঘ হবো’ কবিতাটি তেমন মুগ্ধতার পরশ জাগায়। ‘বাবা আমার নীল আকাশের তারা’ কবিতায় শেষ চরণে বলছেন, ‘তাই প্রতিরাত ঘুমের আগে, নীল আকাশে তোমায় খুঁজি/ যে তারাটি আমায় দেখে, সে তারাটি তোমার বুঝি?’ বাবাকে তার প্রিয় তারার মাঝে কবি খুঁজে ফিরেছেন নান্দনিক এক কবিতার ভাষায়।
কবি ইসমাইল জসীমের এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই কিশোরকবিতার চমৎকার উদাহরণ। তাঁর বুননশৈলী, চিত্রকল্প ও ছন্দের প্রকরণে কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। প্রজাপতি, ডানপিটে মন ছেলে, খেলার সাথি বৃষ্টি ভেজা মাঠ, কোথায় পাবো মাঠ, কিশোর বেলার স্মৃতি, আমরা হলাম বীর বাঙালি, আজ বিজয়ের উল্লাসে, আকাশের সাথে মিতালি, ফুলপরিদের সাথে শিরোনামের কবিতাগুলো কিশোর কবিতার আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে পূর্ণাঙ্গ কিশোরকবিতাই বলা যায়।
কবিতা মনের খোরাক, কবিতা লেখার জন্য প্রয়োজন মনের একান্ত অনুভব, সেই অনুভব মনে জাগ্রত না হলে কবিতা লেখা যায় না। কবি ইসমাইল জসীম সেই অনুভবে সময়ে সময়ে নিজেকে কবিতার কাছে সমর্পণ করেছেন। ফলে মনে হচ্ছে সময় নিয়েই তিনি একগুচ্ছ সুন্দর কিশোরকবিতার ঢালি নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। মোমিন উদ্দীন খালেদের চমৎকার প্রচ্ছদ ও পীযূষ সরকারের ভেতরের কবিতার সাথে ইলাস্ট্রেশন দিয়ে সাজানো শৈলীর এ প্রকাশনা অনন্য একটি কাজ। দাম রাখা হয়েছে বইটির ২২০ টাকা। বইটি পাঠক প্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। লেখক: কবি ও গীতিকার।