নগরীর পাঁচলাইশ জাতিসংঘ পার্কে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নির্মিত দুইটি সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম অপসারণের প্রস্তাব যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনে। পার্কটির সুবিধাভোগীদের সম্মতির প্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশে জেলা প্রশাসন, সিএমপি, চসিক এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত পর্যালোচনা কমিটি এ প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। ২০১৫ সালের জুন মাসে ৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকায় ‘ত্রুটিপূর্ণ’ সুইমিং পুল দুইটি নির্মাণ করেছিল চসিক।
জানা গেছে, পার্কটির উন্নয়নে ২০১৭ সালে ১২ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার টাকায় ‘পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান’ শীষর্ক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল গণর্পূত অধিদপ্তর। তবে চসিকের আপত্তিতে দীর্ঘদিন পরিকল্পনা কমিশনে আটকে ছিল প্রকল্পটি। পরবর্তীতে ২০২০ সালের শেষের দিকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয় চসিক। এরপর গতি পায় প্রকল্পে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় প্রকল্পটি নিয়ে একাধিক পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, চসিকের নির্মিত সুইমিং পুল দুটি নিয়ে।
সভায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বলেন, জিমনেশিয়াম ও সুইমিংপুল পরিকল্পিত ও মানসম্মতভাবে নির্মাণ করা হয়নি। তাই এগুলো ভেঙে পুনঃনির্মাণের সংস্থান রাখা হয়েছে প্রকল্পে। পরবর্তীতে জিমনেশিয়াম এবং সুইমিংপুলের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং এগুলো ভেঙে পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয় সভায়। এ লক্ষে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, সিএমপি, চসিক এবং গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটি চলতি মাসের শুরুতে মিটিংও করে। প্রাথমিকভাবে তারা সুইমিংপুল ও জিমনেশিয়াম ভাঙার বিষয়ে একমত হয়েছেন। মিটিংয়ের সিদ্ধান্তটি রেজ্যুলেশন আকারে দ্রুত পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ দৈনিক আজাদীকে বলেন, জিমনেশিয়ামটি ক্রাক হয়ে গেছে। সেটি অনেক রিস্কি। সুইমিং পুলের গভীরতা বেশি। এটাকে ব্যবহার উপযোগী করতে গেলে আবার পুনঃনির্মাণ করতে হবে। তাছাড়া পার্কটির যারা সুবিধাভোগী বিশেষ করে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার লোকজন চান না সুইমিং পুল থাকুক। সুইমিং পুল রাখতে চাইলে বর্তমানে যেভাবে আছে সেভাবে রাখতে হবে। এতে পার্ক ছোট হয়ে যাবে। তাই পার্কের সুবিধাভোগীরা চান সুইমিং পুল ভেঙে ফেলা হোক। বিষয়টিই আমরা জানাব। এখন যদি মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেয়, সুইমিং পুলটি ভেঙে ফেলা হবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্পে কী কী ফ্যাসিলিটি রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওয়াকওয়ে থাকবে। সবুজায়ন করা হবে। মাঝখানে ঝরনা থাকবে। লাইটিং করা হবে। টয়লেট জোন থাকবে। বাউন্ডারি করা হবে গ্রিল দিয়ে যাতে বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যায়।
এ বিষয়ে চসিকের নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর দৈনিক আজাদীকে বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তর যদি আমাদের সুইমিং পুল ভাঙার প্রস্তাব দেয় সেক্ষত্রে আমরা নিলামের মাধ্যমে সেটা ভেঙে ফেলব। তিনি বলেন, মেয়র মহোদয় চাচ্ছেন সেখানে মানুষের জন্য সুন্দর একটি পার্ক হোক। সেটা যে সংস্থাই করুক না কেন জনগণের উপকার হলেই হবে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে চসিক জাতিসংঘ পার্ক নামকরণ করে। শিশু কিশোরসহ বিনোদন প্রেমী মানুষের কাছে এ পার্কটি সে সময় দর্শনীয় স্থান হিসেবে মন জয় করে নেয়। কিন্তু দিনে দিনে পার্কটির প্রতি অবহেলা আর অযত্নের চাপ পড়তে থাকে। এতে পার্কটি জৌলুস হারায়। এটি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পৌঁছে যায়। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে পার্কের পুকুরটিও। ওই অবস্থায় ২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ পার্কের একটি অংশে সুইমিং পুল নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম। ২০১৫ সালের জুনে সুইমিং পুলটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পরবর্তীতে আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সুইমিং পুলটির বিভিন্ন নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে চসিকের উদ্যোগে মেয়র আ জ ম নাছির এ সুইমিং পুল এবং জাতিসংঘ পার্ককে ঘিরে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ওই সময় ২৫ বছরের ইজারা দেয়ার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘এলিট পার্ক’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় চূড়ান্ত করা হয়। বিষয়টি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৬ মে ‘জাতিসংঘ পার্কে কমিউনিটি সেন্টার, গেস্ট হাউস’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ক্ষোভ জানায় এলাকাবাসী। এরপর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির পক্ষে উচ্চ আদালতে করা একটি রিটের প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৯ জুন বিচারপতি এমদাদুল হক ও বিচারপতি জাফর আহমদ পার্কটির ২৫ বছরের ইজারা প্রক্রিয়া স্থগিতের নির্দেশ দেন। ফলে আটকে যায় চসিকের উদ্যোগ।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তর তাদের পার্কের উন্নয়নে প্রকল্প নেয়। ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে একই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর চসিক মেয়র নাছির স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে একটি পত্র দেন। একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায়ও চসিক প্রতনিধি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটির বিরুদ্ধে আপত্তি জানান। এতে স্থগিত করা হয় গণপূর্তের প্রকল্পটি। একই বছরের ১১ অক্টোবর পার্ককে ঘিরে চসিকের গৃহীত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্যকে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি চসিক। অন্যদিকে আটকে থাকে গণপূর্তের প্রকল্পটিও। এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবরে আ জ ম নাছির ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন পারস্পরিক আলাপে একমত হন- গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিককে হস্তান্তর করবে। পরের বছর প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকালে খোরশেদ আলম সুজন গণপূর্ত অধিদপ্তরকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাপত্তি পত্র দেয়। এদিকে পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির করার রিটটি প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ।
উল্লেখ্য, পার্কটির মালিকানা নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর চসিকের বিরুদ্ধেও একটি মামলা করেছিল। সেটা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।