সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা হোক বিশ্বমানের

কামরুন্নাহার রোজী | মঙ্গলবার , ৯ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ

মাত্র কিছুদিন আগেও শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ফলাফল ভিত্তিক পরীক্ষা ভিত্তিক। আজ সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষা পদ্ধতিতে আবারো পরিবর্তনের কথা এসেছে। জনমনে উঠেছে প্রশ্নের ঝড়। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মনে আতঙ্ক। এসব কিছু মিলিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কি হুমকি স্বরূপ, জাতির সফলতা কি আশঙ্কাজনক? প্রশ্নোত্তরের দোলায় দোদুল্যমান আজকের শিক্ষা ক্যাম্পাস।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাস ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে আমরা সকলেই তা অবগত। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পড়শী সবাই কোনো না কোনোভাবে এই শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে কম বেশি পরিচিত। এই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে একটু অন্যরকম যা আনন্দঘন পদ্ধতিতে পরিচালনা করা, একরকম শিক্ষাকে মন্টেসরি পদ্ধতি বলা যায়। কিন্তু সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা পদ্ধতি কি একইভাবে পরিচালিত হয়েছে? হঠাৎ করে একটা পরিবর্তন আসায় শিক্ষকশিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা হযবরল পরিস্থিতিতে গেছে গত বছর। কারণ নির্দেশনার সাথে বাস্তবায়ন, বাস্তবায়নের সাথে সফলতা চারটিখানি কথা নয়। বিশেষ করে জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও শিল্প সংস্কৃতিমূলক বইয়ের কথা যদি ধরি। বইগুলোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা মুখস্ত করার চেয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হবে, জাতিকে স্বনির্ভর করবে। বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যাতে করে আমাদের দেশে প্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ মানুষ তৈরি হয়। নিঃসন্দেহে এটি চমৎকার ইতিবাচক পরিকল্পনা। এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হয়তো কিছু সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, যা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা জরুরি।

কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বোর্ডে শিক্ষক এসাইনমেন্টের জন্য প্রশ্ন লিখে দেয় আর সেটা তুলে নেয় শিক্ষার্থীরা। বাসায় এসে সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ রাখে শিক্ষার্থী। লাইনের পর লাইন পড়তে থাকে সমাধান খুঁজে পায় না। প্রায় লাইনেই বলা হয়েছে অনুমান করো ধারণা করো চিন্তা করো এবার বুঝে নাও…. দুঃখের বিষয় ওরা বোঝে না। বুঝা তো দূরের কথা ওদের মাথায় পড়ে বাজ, শুরু হয় উচ্চচাপ, মধ্যচাপ, নিম্নচাপ। বলা হয়েছে কোচিং বা গাইডের সহযোগিতা নিতে হবে না এমনকি প্রাইভেট টিউটরেরও প্রয়োজন পড়বে না। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নেয় ডিজিটাল ডিভাইসের। তাছাড়া যে অনুমানে বা ধারণায় বা বিশ্বাসে শিক্ষার্থীরা সমস্যাগুলো নিয়ে আসে বাসায়, শেষে তা হয় গুড়েবালি।

বইগুলোতে কোনো কোনো জায়গায় বলা হয়েছে জীবজন্তু পর্যবেক্ষণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তালিকা তৈরি করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই শহরের আনাচেকানাচে সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের পরিবেশ খুবই দুর্লভ। হয়তো গ্রামীণ পরিবেশে সম্ভব হতে পারে। এক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরের ছাত্রছাত্রীদের অভিজ্ঞতা অর্জনে বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে।

বলা হয়েছে উপকরণের মাধ্যমে ডেকোরেশন করতে। শিক্ষার্থীরা যেন লিফলেট, দেয়ালিকা, পোস্টার প্রতিবেদন বা জার্নাল তৈরি করে একটা কার্যক্রম তৈরি করে। এগুলো তৈরি করতে শিক্ষার্থীদের রঙিন কাগজ, রঙিন কলম, জেলপেন, জরির কাগজ, গ্লু, স্টাপলার, কাঁচি, স্কচটেপ ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। কোনো কোনো জায়গায় এসব উপকরণ দুষ্প্রাপ্য হতে পারে। তাছাড়া সব ধরনের শিক্ষার্থীর পক্ষে এই ব্যয়ভার বহন করাও মুশকিল।

কোনো কোনো স্কুলে মাটি দিয়ে ডাইস বা নকশা বানাতে বলা হয়। গ্রামের কথা নাইবা বললাম। কিন্তু এই শহরের আনাচেকানাচে কোথাও কোথাও মাটি পাওয়াও দুরূহ ব্যাপার। কীভাবে বানাবে তা খুঁজতে খুঁজতে গুগোলে পাওয়ার পরে ছাই আর মাটি দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ডাইস বানানো হয় অনেক রাতে। কারণ পরবর্তী দিন স্কুলে তা জমা দিতে হবে। তাছাড়া এ ধরনের সময়ের ফাঁদে পড়ার আরেকটা কারণ হলো কোনো কোনো স্কুলে এসাইনমেন্টের নোটিশ আসে মোবাইলফোনে সন্ধ্যার দিকে। কাগজ কেটে ফুল পাতা বানিয়ে আর্টপেপারে এঁটে একটা ডিজাইন তৈরি করে প্রেজেন্টেশন দিতে হয় স্কুলে।

কোনো কোনো অভিভাবকদের মতে, দলীয় কাজের জন্য যাদের ওপর দায়িত্ব পড়ে দূরত্বের কারণে অথবা সময় স্বল্পতার কারণে ওরা সবাই একত্রিত হতে পারে না। যার কারণে এই ভার পড়ে দুই একজনের ওপর এবং অনেক সময় একটা এসাইনমেন্টের সাথে দুই তিনটা জমা হয়ে যায়। আর এই কাজ করতে করতে রাত দুইটা তিনটাও বেজে যায়। অভিভাবকদের মতে ওরা কখনো ওদের সন্তানদের গভীর রাত পর্যন্ত পড়ালেখা করতে দেয়নি। যেহেতু পরের দিন ওই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে সেজন্য অতিরিক্ত কষ্টটা ওদের ওপর দিয়ে যায়।

অভিভাবকদের মতে, ওরা তো কখনো বলেনি যে পড়ার চাপ হচ্ছে। সবাই যেমন করে অতীতে পড়ালেখা করে আসছে ওদের সন্তানরাও সেইভাবে পড়ালেখা করে যাবে এটাই তাদের কাম্য। পরীক্ষার সুবাদে শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি পড়ার সুযোগ পায় বা আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর এখন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বেশিরভাগ ক্রাফ্‌টের কাজ এবং রঙের কাজ করেই যায়। এবং একটা ক্লাসে কয়েকটা দল থাকে। এক একটা দলে পাঁচ থেকে ছয় জন সদস্য থাকে। এই দলীয় কাজের একজন প্রেজেন্টেশন দেয় দুজন ডেকোরেশনের কাজ করে একজন লিখে দুইজন প্রশ্নের উত্তর দেখে আসে অর্থাৎ শিখে আসে। ছয় জন সদস্যের মধ্যে শুধু দুজনকেই পড়ে আসতে হয়। বাকিদের পড়ে আসতে হয় না। আর পরীক্ষার দিনগুলোতে দুটো প্রশ্ন শিখে যায় একটা প্রশ্ন দলীয় আরেকটা একার। কোনো গ্রামার মডেল কোয়েশ্চেন পড়ার কিংবা মুখস্ত করার তেমন কোনো দরকার হয় না। সপ্তাহের কার্য দিবসের বাকি দিনগুলোতে বইয়ের খালি ছকগুলো পূরণ করতে হয়। এরপরে স্কুলে গিয়ে নিয়ে আসে ত্রিভুজ, বৃত্ত অথবা চতুর্ভুজের মতো সাইন। অনেকের মতে, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গণিত থেকে শুরু করে যে যে বিষয়ের ওপর জ্ঞান ওরা অর্জন করেছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে গিয়ে সবই ভুলতে বসেছে। বইয়ের পাতা খুলে আগের মতো পড়ার টেবিলে বসতে দেখা যায় না কোনও শিক্ষার্থীকে। কারণ ওদের মতে পড়ার চাপ নেই আর পরীক্ষায় কিছু শিখে যেতে হয় না। সেই আদি যুগের মতো বাড়ির সামনের উঠোনে ছাদে বেলকনিতে বারান্দায় হেসে খেলে চলছে ওদের জীবন।

উন্নত দেশের শিক্ষা সম্পর্কে যদি বলতে হয় তাহলে বলবো, যার দোহাই দিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছেহাঁসের মতো প্যাক প্যাক করা অথবা দূরে দূরে লাফিয়ে লাফিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে খেলা করা এগুলো প্রপাগাণ্ডা ছাড়া কিছুই না। এসব কিন্তু শিক্ষানীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস মাত্র।

উন্নত দেশ বলতে জাপান কিংবা বিভিন্ন দেশের কথা যদি বলি তাহলে ওদের ছোটবেলা থেকেই স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি লাইফ স্টাইল সম্পর্কে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। স্কুলেই খাওয়ার পরে দাঁত ব্রাশ করানো, নিজের ব্যাগ গোছানো, বই খাতা গোছানো, পড়ার টেবিল গোছানো, ক্লাসরুম পরিষ্কার করা, এমনকি টয়লেট পরিষ্কার করা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জাপানিদের বড় বড় ডিগ্রি ধারণ করার মানে এই নয় যে চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ইন্টারভিউ দেবে। ওদেরকে স্কুল পেরিয়ে কলেজ লাইফ শুরু করার পর থেকে স্বউদ্যোগী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে সেই অবস্থায় উন্নীত হচ্ছে। শুধু এখন কিছু বিষয়ের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমার মতে, জীবন জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং শিল্প সংস্কৃতি থেকে দুটো প্রশ্ন নয়, ক্লাসে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করলে সহায়ক হয়। একটি প্রশ্নোত্তর সম্পর্কে অগ্রগামী শিক্ষার্থীর উচ্চ জ্ঞানের সাথে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর ক্ষুদ্র জ্ঞানের সম্মিলন করে শিক্ষক আরো বৃহত্তর জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে পারে। সেই সাথে মজার পরিবেশ সৃষ্টি করার পরিস্থিতি যেন ঘটে সেই ধরনের শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করার ওপর গুরুত্ব থাকা চাই। যাতে ক্লাসে একজনের দেখাদেখি সবাই সমানভাবে শিক্ষিত হয়ে উঠার সুযোগ পায়।

ডেকোরেশন বা এসাইনমেন্ট এর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলোর ব্যবহার শিক্ষার্থীর পরিবর্তে সরকার কর্তৃক গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। রান্না বা অন্যান্য শিক্ষনীয় কাজে দক্ষ করে তোলার কাজগুলো শ্রেণিকক্ষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সহায়তায় করা উভয়ের জন্য অধিকতর উৎসাহব্যাঞ্জক। বইয়ের ভেতরের ফাঁকা ছকগুলো পূরণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সরাসরি শিক্ষক সহায়তা আবশ্যক।

জীবজন্তু বা পরিবেশ থেকে যে অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানার্জনের কথা বলা হয়েছে তা শহরাঞ্চলে দুর্লভ। এটাও স্কুল কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক শিক্ষা সফরের প্রতি গুরুত্ব দিলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন ও আনন্দ দুটোই রক্ষা হবে।

এই শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একই সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ না করে ধাপে ধাপে করাই উত্তম। যেমন এই বছর প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ, সপ্তম পরের বছর তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম, নবম এর পরের বছর পঞ্চম, দশম এর পরের বছর একাদশ এবং সবশেষে দ্বাদশ।

শিক্ষা ব্যবস্থার এই পরিবর্তনের ধারায় সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য ক্লাসে কার্যকর করার আগে শিক্ষকদের যথোপযুক্ত বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।

মোটের ওপর শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশসহ সর্বক্ষেত্রে মানবিকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব উন্নত করার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া বাঞ্ছনীয়। শিক্ষানীতিতে এমন পরিবর্তন সবারই কাম্য। এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক ছোঁয়া লাগুক। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে এমন মনোভাবকে সাধুবাদ জানাই। পরিবর্তন সফল হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধউচ্ছৃঙ্খলতা কখনোই আধুনিকতা নয়
পরবর্তী নিবন্ধঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে বিদেশ যাত্রা : দেশের জন্য অশনি সংকেত