ভারতে করোনার ভয়াল পরিস্থিতি। কিন্তু চিকিৎসাসহ নানা কারণে ওখানে আটকা পড়েছেন কয়েক হাজার বাঙালি। এরা দেশে ফিরতে মরিয়া। আবার চাকরি ও ব্যবসাসহ নানা কাজে হাজার হাজার ভারতীয় কাজ করেন বাংলাদেশে। দেশে গিয়ে আটকা পড়া এই ধরনের কয়েক হাজার ভারতীয় বাংলাদেশে ফিরতে চাচ্ছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এদের আসা-যাওয়া বন্ধসহ ভারত ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং সীমান্ত সিল করে দেওয়ার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নতুন ভেরিয়েন্টের ভাইরাসের কারণে ভারতে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই ঊর্ধ্বমুখী। ইউকে ভেরিয়েন্ট ও ডাবল মিউটেশন ভেরিয়েন্ট (ইন্ডিয়ান ভেরিয়েন্ট) চালাচ্ছে এই ধ্বংসযজ্ঞ। এই ডাবল/ট্রিপল মিউট্যান্ট কোভিড ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ভারতে তাণ্ডব চালানো নতুন ভেরিয়েন্টটির উৎস পশ্চিমবঙ্গ। এটির নাম দেয়া হয়েছে ‘বেঙ্গল স্ট্রেইন’। ১৩০টি জিনোম সিকুয়েন্সিং করে ১২৯টি পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গে। গতকাল একদিনে দেশটিতে করোনায় মৃত্যু হয়েছে আড়াই হাজারের বেশি মানুষের। নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ। বিশ্বের আর কোনো দেশে একদিনে এত রোগী শনাক্ত হয়নি। প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
ভারতের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকটি গবেষণার উদ্ধৃৃতি দিয়ে বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, ১৫ দিনের মধ্যে ভারতে কোভিডে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হতে পারে ৫ হাজার ৬০০। এর ফলে ১২ এপ্রিল থেকে ১ আগস্টের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে আরও প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের।
আরেকটি গবেষণা বলছে, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোভিডে ভারতে দৈনিক মৃতের সংখ্যা বেড়ে হতে পারে সাড়ে ৪ হাজার। জুলাইয়ের শেষে সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়বে আরও ৮ থেকে ১০ লক্ষ।
ভারতে চিকিৎসার জন্য গিয়ে কোভিড আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য গিয়ে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যান কঙবাজারের সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বকশি। আরও অনেকে ভারতে রয়েছেন। কেউ চিকিৎসার জন্য আটকা পড়েছেন, কেউবা অসুস্থ হয়ে।
জানা গেছে, বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি ও ভারতীয় প্রতিদিন বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে আসা-যাওয়া করছেন। যাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিদেশফেরতদের ব্যাপারে কোয়ারেন্টাইন করার কথা থাকলেও ভারত থেকে আসা লোকজন কেয়ারেন্টাইন করছেন না। তারা নিজেদের মতো করে বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে সারা বিশ্ব ভারতকে রেড লিস্টে রেখেছে। অর্থাৎ এই সংকটকালীন সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ভারত থেকে আগমন-প্রস্থানের সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। কিন্তু এখানে তা করা হয়নি। তাই যেকোনো মুহূর্তে ভারতের ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং সীমান্ত বন্ধ করার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, এই ধরনের সিদ্ধান্ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যাপার। আমরা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারি না। তবে আমরা চরম ঝুঁকির মধ্যে আছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। এখানে আপোষ করলে শুধু নিজে নয়, সবাই বিপদে পড়বে।
সীমান্তে কড়াকড়ি চায় জাতীয় কমিটি
বিডিনিউজ জানায়, ভারতে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশটির সঙ্গে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে জানিয়েছেন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ। গতকাল তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে খুব বেশি যাতায়াত হলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অবশ্যই থাকে। আমরা বর্ডারে কড়াকড়ি করতে বলছি। আসা-যাওয়া সীমিত করতে হবে। এর মানে একেবারে প্রয়োজন ছাড়া কেউ ভ্রমণ করবেন না। কোনোরকম পর্যটন, বিনোদন বা সাধারণ কারণে যাতায়াত বন্ধ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি, সীমিত করতে না পারি এবং কোয়ারেন্টাইন করতে না পারি তাহলে এটা তো ছড়িয়ে পড়বেই। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় কমিটির সদস্যরা এর মধ্যে কথা বলেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি সরকারকে জানানো হবে। আমরা এখনও সুপারিশ করিনি। তবে করব। সদস্যদের মিটিংয়ে এটা আলোচনা হয়েছে।
জরুরি প্রয়োজনে কেউ চলাচল করলে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক ভ্রমণকারীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যদি বর্ডার পুরো বন্ধ না করা যায়, তাহলে যারা ভারত থেকে আসবে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। এটার বিকল্প কিছু নাই।
তিনি আরও বলেন, এখন ভারত থেকে যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের নাগরিক। বর্ডার বন্ধ করে তাদের আটকানো যাবে না। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই ৭২ ঘণ্টা আগে নমুনা পরীক্ষা করাতে হবে। করোনাভাইরাস নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে। আসার পর অবশ্যই কোয়ারেন্টাইন। সম্ভব হলে সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। সম্ভব না হলে কঠোরভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে।











