মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা ও সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাতের প্রভাবে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত বাণিজ্য। এতে টানা তিন মাস ধরে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে আমদানি–রপ্তানি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য লেনদেন বন্ধ থাকায় বিপুল রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। কাস্টমসের তথ্য মতে, গত তিন মাসে আনুমানিক দেড়শ কোটি টাকা হারিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে নষ্ট হয়েছে আলু, সিমেন্টসহ বিপুল পরিমাণ কাঁচা পণ্য। এর ফলে বিপুল অংকের ক্ষতির শিকার হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই বাণিজ্য সমস্যা সমাধানে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এতে অনিশ্চয়তায় পড়েছে দুই দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। বাংলাদেশের সীমান্ত কেন্দ্রিক মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রায় দুই বছর ধরে বিভিন্ন সময় জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় জান্তা ও আরাকান আর্মি। এর মধ্যে ইয়াঙ্গুনে বন্ধ করে জান্তা সরকার এবং মংডুতে বন্ধ করে আরাকান আর্মি।
টেকনাফ স্থলবন্দরের তথ্য মতে, গত বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমার অংশের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইয়াঙ্গুন থেকে টেকনাফে স্থলবন্দরে আসার পথে চারটি পণ্যবাহী নৌযান আটক করে কমিশন দাবি করে আরাকান আর্মি। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে গত ছয় মাস ধরে ইয়াঙ্গুন থেকে বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণা করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
অন্যদিকে জান্তা সরকারের সাথে আধিপত্য কেন্দ্রিক পাল্লা দিয়ে গত ১৩ এপ্রিল থেকে টেকনাফ–মংডু সীমান্তে আমদানি–রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ এর আগের দিন ১২ এপ্রিল আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইন রাজ্যে মংডু থেকে একটি কাঠের বোট এসেছিল। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে আর কোনো ধরনের পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হয়নি। সে হিসেবে তিন মাস ধরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, বাণিজ্য বন্ধ থাকায় টেকনাফ স্থলবন্দর এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। পুরো বন্দর এলাকা খাঁ খাঁ করছে। রপ্তানির জন্য মজুদ করা আলুসহ বিভিন্ন পণ্য পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গুদামে পড়ে আছে মালামাল। এছাড়া জেটিঘাটে নেই কোনো পণ্যবাহী ট্রলারও। কাজ না থাকায় বেকারত্ব দিন পার করছে হাজারো শ্রমিকসহ আমদানি–রপ্তানিকারকের প্রতিনিধিরাও।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বন্দরের কয়েকটি গুদামে ২ হাজার ৭০০ বস্তা আলু, ২২ হাজার ৮৫০ বস্তা সিমেন্ট, ১ হাজার ৯০ বস্তা কোমল পানীয় রয়েছে। এছাড়া চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, প্লাস্টিক পণ্য মজুদ রয়েছে। ইতিমধ্যে সব আলু নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকশ বস্তা সিমেন্টও নষ্ট হওয়ার পথে।
আমদানিকারক এঙপ্রেস এজেন্সির প্রতিনিধি মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধের পর গত তিন মাস ধরে পুরোপুরিভাবে আমদানি–রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এর আগে মংডুর সাথে ব্যবসা চালু ছিল; সেটিও বন্ধ। এর প্রভাবে স্থলবন্দরে আমাদের আমদানিকৃত আলু পচে গেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সিমেন্টও। এতে শতাধিক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিপাকে পড়েছেন। জানি না কবে আবার স্থলবন্দরের ব্যবসা সচল হবে। এর মধ্য অনেকে চট্রগ্রাম বন্দরে ব্যবসা চালু করছে।
স্থলবন্দর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, টেকনাফ স্থলবন্দরে সীমান্ত বাণিজ্যে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের আমদানিতে ১১০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। বিপরীতে রপ্তানি ক্ষেত্রে ৯ লাখ ৯৭ হাজার ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে আমদানিতে ৪৪০ কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন করে। এর বিপরীতে রপ্তানিতে ২ লাখ ২৪ হাজার ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। ২০২২–২৩ অর্থবছরের আমদানিতে ৬৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানিতে ২ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। এর মধ্য গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে রাখাইন রাজ্যে সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ২৩৮ টন, আলু রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ১৭৪ টন। সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থাকায় আনুমানিক দেড়শ কোটি টাকা হারিয়েছে সরকার।
টেকনাফ স্থলবন্দরের কাস্টম কর্মকর্তা মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, স্থলবন্দরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। গত এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের সাথে আমদানি–রপ্তানি বন্ধ আছে। বন্দরকে সচল করার জন্য বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষসহ আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তারই সূত্র ধরে জেলার সকল স্টেকহোল্ডার নিয়ে একটি বৈঠকও হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে রপ্তানিকৃত কিছু আলু পচে গেছে। এছাড়া সিমেন্টও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আশা করছি বন্দরের কার্যক্রম ফের চালু হবে।
টেকনাফ ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তিন মাস ধরে স্থলবন্দরে আমদানি–রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এতে বন্দরের প্রায় কোটি টাকার পণ্যের ক্ষতি হয়েছে। বন্দরে কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এখানকার জনবল অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, আমদানি–রপ্তানি বন্ধ থাকায় একদিকে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে সরকার বিপুর রাজস্ব হারাচ্ছে। এই অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সংশ্লিষ্টরা সবাই মিলে চেষ্টা চালাচ্ছি।